সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিরুদ্ধে আদালতে পাল্টা দুইটি মামলা দায়েরের কয়েকঘন্টা পরেই দুইপক্ষের মধ্যে সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তিন ঘন্টার বৈঠকে গত পাঁচদিন ধরে প্রশাসন, সিটি মেয়র ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দর চলমান সকল দ্বন্ধের অবসান হয়েছে।
এদিকে অতীতের সকল ভুল বোঝাবুঝি ভুলে নান্দনিক বরিশাল গড়ার লক্ষ্যে নগর প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন ঐক্যবদ্ধ এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন (বিসিসি)।
সোমবার দুপুরে সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ দপ্তর থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত ১৮ আগস্ট রাতে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সঙ্গে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ভুল বোঝাবুঝির কারণে যে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছিল তার অবসানকল্পে রোববার দিবাগত রাতে বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারের আহবানে সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের উপস্থিতিতে তিন ঘন্টার বৈঠকে প্রশাসন ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দর সমঝোতা হয়েছে। রোববার দিবাগত রাত সোয়া নয়টার দিকে বৈঠকটি শুরু হয়ে একটানা রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত চলে।
বৈঠকে বরিশালে যা কিছু হয়েছে, সবই ভুল বোঝাবুঝি থেকে হয়েছে দাবি করে উভয়ে সাম্প্রতিক বিষয়াদি নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা করেন। তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর বৃহত্তর স্বার্থে বৈঠকের খুঁটিনাটি জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে চায়ের দাওয়াত দেয়া হলেও আমরা রাতের খাবার খেয়ে ফিরেছি। আলোচনার একপর্যায়ে তৃতীয় পক্ষকে ফায়দা না নিতে দেওয়ার জন্য উভয়ে সকল ভুল বোঝাবুঝির দ্বন্ধ বাঁচিয়ে রাখতে চাইনি। এ বিষয়ে একমত পোষন করে সমঝোতায় আসা হয়েছে। বিষয়টি যাতে আর সামনে না বাড়ে সে বিষয়ে সবাই সম্মত হয়েছেন।
নগরীর রাজাবাহাদুর সড়কের বিভাগীয় কমিশনার সাইফুল হাসান বাদলের সরকারী বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিভাগীয় কমিশনার ছাড়াও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, রেঞ্জ ডিআইজি এসএম আক্তারুজ্জামান, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান, জেলা প্রশাসক মোঃ জসীম উদ্দীন হায়দার, জেলা পুলিশ সুপার মোঃ মারুফ হোসেন, র্যাব-৮ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি জামিল হাসান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর হোসাইন, সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন লিটু উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে অংশগ্রহণ করা একটি সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ আগস্ট রাতের হামলা, সংঘর্ষ এবং পরবর্তী ঘটনাবলী ভুল বোঝাবুঝির কারণে হয়েছে বলে আলোচনা করা হয়। এধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। একইসাথে বরিশালের শান্তি, শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সবাই সহযোগিতা করবেন বলেও একমত পোষন করেছেন।
বৈঠক শেষে বিভাগীয় কমিশনারের সরকারী বাসভবনের সামনে প্রশাসন, পুলিশ কর্মকর্তা, সিটি মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ একসাথে ছবি তোলেন। তবে ওই ছবিতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মুনিবুর রহমানকে দেখা যায়নি। মুহুর্তের মধ্যে ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মুনিবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি বৈঠকে ছিলেন না। ওখানে কী আলোচনা হয়েছে তাও তিনি জানেন না। সমঝোতার কোনো বিষয় থাকতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা মাঠ প্রশাসনে কাজ করি। এখানে নিজেদের কোনো স্বার্থ নেই।
বৈঠকে অংশগ্রহণ করা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস জনকণ্ঠকে বলেন, বরিশালবাসী শান্তি চায়, আমরা অতীতের ন্যায় সেই শান্তি ফিরিয়ে আনতে বৈঠকের মাধ্যমে অনেক দূর এগিয়েছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা প্রশাসনের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে দুইপক্ষের পাল্টাপাল্টি মামলাগুলো সরকারী কৌঁসুলির (পিপি) সাথে আইনগত দিক আলোচনা করে প্রত্যাহারের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ ব্যাপারে সোমবার দুপুরে আইনজীবী অ্যাডভোকেট দিলীপ কুমার ঘোষ বলেন, সমঝোতা হলে বাদি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন আর পুলিশের মামলা তদন্তের মাধ্যমে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হবে।
রোববার রাতের এ সমঝোতা বৈঠকের আগে ওইদিন দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংকালে বরিশালের ঘটনায় সমঝোতার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, বরিশালের ঘটনাটি ভুল বোঝাবুঝি থেকে হয়েছে। এটা এখন নিরসনের পথে। উভয়পক্ষ নিজেদের অবস্থান থেকে নিরসনের চেষ্টা করছে। মন্ত্রী বলেন, সিটি মেয়র একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। স্বাভাবিকভাবেই তিনি একজন দায়িত্বশীল মানুষ। তারা বুঝেছে, এটা নিজেদের মধ্যে একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং। এটা কারও জন্যই শুভকর না।
বৈঠকে অংশগ্রহণ করা এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সভায় নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গত ১৮ আগস্ট রাতের ঘটনার রেশ আর সামনে আগাবে না। গ্রেফতারকৃত আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের জামিনেরও বিরোধীতা করা হবেনা। প্রশাসন তাদের মনোভাব থেকে নিজেদের সংযত করার পাশাপাশি গ্রেফতার অভিযান বন্ধ রাখবেন।
সমঝোতা বৈঠকের পর সবাই খুশি জানিয়ে সোমবার সকালে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রশাসনের দায়ের করা দুটি মামলা প্রত্যাহার করা হবে। এতে গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীদের জামিন সহজ হবে। আমাদের দায়ের করা দুটি মামলা নিয়েও দলীয়ভাবে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
এদিকে সমঝোতা বৈঠকের পর সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিবাদে বরিশাল চেম্বার এবং সিটি কাউন্সিলরদের ডাকা সোমবারের সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, রোববার (২২ আগষ্ট) বরিশালের অতিরিক্ত মহানগর হাকিম মাসুম বিল্লাহর আদালতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান ও কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি নুরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুটি মামলার আবেদন করা হয়। সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন এবং সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা বাবুল হালদার বাদি হয়ে এ আবেদন করেন। ওইদিন শেষকার্যদিবসে আদালতের বিচারক অভিযোগ দুটি আমলে নিয়ে পিবিআই’কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
এর আগে ১৯ আগস্ট দুপুরে ইউএনও’র বাসভবনে হামলার অভিযোগে পুলিশের সাথে সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। ইউএনও এবং পুলিশ বাদি হয়ে দায়ের করা পৃথক দুটি মামলায় সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে প্রধান আসামি করে ৬০২ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় ইতোমধ্যে সিটি কর্পোরেশনের এক কাউন্সিলরসহ ২২ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
গত ১৮ আগস্ট দিবাগত রাতে সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারীরা নগরীর সিঅ্যান্ডবি সড়কের উপজেলা পরিষদ কম্পাউন্ড থেকে পুরনো শুভেচ্ছা ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করতে যায়। এ সময় ইউএনও মুনিবুর রহমানের সাথে সৃষ্ট বিরোধকে কেন্দ্র করে গুলিবর্ষন ও পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতাকর্মী, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা আহত হন। এ সময় ইউএনও’র সরকারী বাসভবনে হামলার অভিযোগ করা হয়।
রদবদলের আভাস ॥ স্থানীয় প্রশাসনে রদবদল হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনে হামলার অভিযোগে দায়ের করা মামলা ও সিটি মেয়রের পক্ষ থেকে পাল্টামামলা প্রত্যাহারের নিতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলেও রদবদলের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনে রদবদল হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন একটি দায়িত্বশীল মহল।