এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি সভ্যতার স্বর্ণযুগে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি সবদিক দিয়েই নিজেদের সাফল্যের চূড়ায় দাবি করি। সত্যিই কি আমরা ২৫০০ বছর পূর্বের সমাজ, রাষ্ট্র থেকে এগিয়েছি? আমাদের শিক্ষা কি আমাদের উন্নত, মানবিক মানুষ তৈরি করতে পেরেছে?
বৃজি নামক রাজ্যের রাজধানী বৈশালী। বৈশালী ছিল গণতান্ত্রিক শহর। বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। আমবাগানে একটি আমগাছের নিচে একটি শিশুকে কুড়িয়ে পান এক নিঃসন্তান দম্পতি। পরম যতেœ শিশুটিকে বাড়িতে নিয়ে এসে তারা বুকে করে লালন-পালন করেন। শিশুটির নাম রাখেন আ¤্রপালি। আ¤্র অর্থ আম আর পালি অর্থ নবীন পাতা। আমগাছের নিচে পাওয়ার কারণে শিশুটির নাম রাখা হয় আ¤্রপালি। আ¤্রপালির পালিত পিতার নাম মহানামন। মাতার নাম জানা যায়নি।
আজ থেকে ২৫০০ বছর পূর্বে আগুনের মতো রূপ নিয়ে জন্মানো আ¤্রপালির রূপের অনলে ঝাঁপ দিতে দেশ-বিদেশের রাজা, মহারাজা, বণিক, নগরপতি, মহাজন ছুটে আসতে লাগল। এই অসাধারণ সুন্দরী নারীকে পাওয়ার জন্য শুরু হলো দ্বন্দ্ব। সমস্যায় পড়ে গেলেন আ¤্রপালির পিতা। কাকে ছেড়ে কার হাতে তুলে দেবেন মেয়েকে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। যাকেই নিষেধ করেন তার সাথেই শুরু হয় শত্রম্নতা। উপায় না দেখে সিদ্ধান্তের জন্য দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হন মহানামন।
আ¤্রপালির ব্যাপারে রাজদরবারে সভা বসে। সেখানে তাকে ডাকা হয়। কিন্তু আ¤্রপালিকে দেখার পর চমকে ওঠেন সবাই। একবাক্যে সবাই বলে ওঠেন এত মানবী নয়, এ তো চাঁদ। আকাশের চাঁদ কারও একার হতে পারে না। সে সবার। তাই আ¤্রপালিও কোনো একজনের হতে পারে না। ফলে বৈশালী রাজ্যের রাজাসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা সিদ্ধান্ত নেন, 'যেহেতু আ¤্রপালিকে সবাই চায় এবং আ¤্রপালিকে কেউ একা নিজের করে নিতে পারবে না। তাই আ¤্রপালিকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। আ¤্রপালি হবে নগরবধূ অর্থাৎ সে হবে সকলের।' বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থেও নগরবধূর উলেস্নখ আছে। নগরবধূকে জনপদ কল্যাণী বলেও উলেস্নখ করা হয়েছে। এই নগরবধূ বা জনপদ কল্যাণী সাধারণ পতিতার মতো নয়। তারা হবেন অভিজাত আদব-কায়দা রপ্ত সুন্দরী। যে নৃত্যগীতে পারদর্শী হবে। শুধুমাত্র উচ্চ বংশের পুরুষই পেতে পারবে তার সঙ্গ সুখ। আ¤্রপালির পিতা ক্ষুব্ধ হলেন বিশিষ্টজনের সিদ্ধান্তে। তিনি প্রতিবাদ করতে চাইলেন। কিন্তু বুদ্ধিমতী আ¤্রপালি বুঝে গিয়েছিল রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার দুঃসাহস দেখিয়ে লাভ নেই। যদিও আ¤্রপালি এই সিদ্ধান্ত শোনার পর একবার আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন।
অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও কিছু শর্ত রাখলেন। শর্তগুলো হলো-
১/ তার ঘর হবে নগরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গায়।
২/ প্রতিরাত্রে তার মূল্য হবে পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা।
৩/ একবার মাত্র একজন তার ঘরে প্রবেশের অনুমতি পাবেন।
৪/ শত্রম্ন বা কোনো অপরাধীর সন্ধানের জন্য প্রয়োজনে তার ঘরে সপ্তাহে সর্বোচ্চ একবার মাত্র প্রবেশ করা যাবে।
৫/ তার ঘরে কে এলো কে গেল তা নিয়ে তাকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।
৬/ সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার পছন্দই গুরুত্ব পাবে।
আ¤্রপালির এই সিদ্ধান্তকে সেদিন মেনে নিয়েছিল সবাই।
বৈশালী রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপবতী মেয়ে, যে বাদ্য, সংগীত, নৃত্যে অসাধারণ পারদর্শী তাকে বলী হতে হলো ক্ষমতাবান, কামনার্ত পুরুষের লালসার কাছে। সেদিন রাষ্ট্র, সমাজ আ¤্রপালির পাশে দাঁড়ায়নি। ন্যায়ের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে সেদিন।
ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা বিম্বিসার। এই বিম্বিসার কথা আমরা জীবনানন্দের 'বনলতা সেন' কবিতায় পাই। বিম্বিসার ছিল ৫০০-এর বেশি স্ত্রী। নর্তকী ছিল অগণিত। একবার যুদ্ধজয়ের আনন্দে নাচ-গানের আয়োজন হয়। সেই নাচের আসরে এক নর্তকীর নাচ দেখে আবেগে আপস্নুত হয়ে বিম্বিসার বলেছিলেন, এই নর্তকী বিশ্ব সেরা। সেদিন সভাসদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি বৈশালী থেকে মগধে এসে বিম্বিসার রাজ দরবারে কাজ নিয়েছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, মহারাজ এ নর্তকী আ¤্রপালির নখেরও যোগ্য নয়। এ কথা শোনার পর মগধের রাজা আ¤্রপালি সম্পর্কে সব খোঁজ-খবর নিলেন। তিনি আ¤্রপালিকে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। ছদ্মবেশে তিনি আ¤্রপালির মহলে প্রবেশ করেন। মহলের দেয়ালে ছিল নানা রাজা মহারাজার ছবি আঁকা। বিম্বিসার ছবিও ছিল সেখানে। এই ছবি দেখেই আ¤্রপালি বিম্বিসার প্রেমে পড়েছিলেন। ফলে ছদ্মবেশে গেলেও তাকে দেখে ঠিকই চিনে ফেলেন আ¤্রপালি।
মগধের রাজা আ¤্রপালিকে রাজবধূর স্বীকৃতি দিয়ে মগধে নিয়ে যেতে চাইলেন। মগধ আর বৈশালীর মধ্যে ছিল চির শত্রম্নতা। তাই যুদ্ধে বৈশালী দখল করে আ¤্রপালিকে নিজ রাজ্যে নিয়ে যেতে চাইলেন। আ¤্রপালি নিজ দেশ আর জনগণের ক্ষতি কিছুতেই চাইলেন না। তিনি রাজি হলেন না। বিম্বিসাকে তিনি মগধে ফেরত পাঠালেন। বিম্বিসার ছেলে অজাতশত্রম্ন। সেও আ¤্রপালির প্রেমে মাতোয়ারা। বাবাকে বন্দি করে দখল করল মগধের সিংহাসন। বৈশালী দখলের জন্য যুদ্ধ করে পরাজিত হয়ে আহত হয়ে আশ্রয় নিল আ¤্রপালির কাছেই। আ¤্রপালি তাকে শুশ্রূষা করে ভালো করে নিজ রাজ্যে ফেরত পাঠালেন।
গৌতম বুদ্ধের সময়কাল তখন। কয়েকশত সঙ্গী নিয়ে গৌতমবুদ্ধ বৈশালীতে এলেন। একজন বৌদ্ধ তরুণ, নাম শ্রমন। বারান্দা থেকে তাকে দেখে আ¤্রপালির ভালো লেগে গেল। তিনি সেই সন্ন্যাসীকে চারমাসের জন্য বুদ্ধের কাছে চাইলেন। বুদ্ধ রাজি হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আমি শ্রমনের চোখে কোনো কামনা, বাসনা দেখছি না। সে চারমাস থাকলেও নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। চারমাস পার হলো। গৌতম বুদ্ধ চলে যাবেন কিন্তু শ্রমনের দেখা নেই। সবাই ভাবছে তাহলে কি আ¤্রপালির রূপের জালে বাঁধা পড়ল শ্রমন? সবার ভাবনার অবসান ঘটিয়ে শ্রমন চলে এলো। শ্রমনের পিছনে এলো আ¤্রপালি। আ¤্রপালি এসে বলল, শ্রমনকে বশ করতে সব রকম চেষ্টাই এই চার মাসে আমি করেছি কিন্তু সফল হইনি। অবশেষে সবকিছু দান করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে বুদ্ধের চরণে আশ্রয় নেন আ¤্রপালি।
১৯৭৮ সালে ভারতের গবেষকরা 'দশোহারি' এবং 'নিলম' এই দুই আমের সংকরায়নের মাধ্যমে নতুন আমের সৃষ্টি করেন। সেই আমের নাম ইতিহাস বিখ্যাত নারী আ¤্রপালির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নামকরণ করা হয় 'আ¤্রপালি।'
এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি সভ্যতার স্বর্ণযুগে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি সবদিক দিয়েই নিজেদের সাফল্যের চূড়ায় দাবি করি। সত্যিই কি আমরা ২৫০০ বছর পূর্বের সমাজ, রাষ্ট্র থেকে এগিয়েছি? আমাদের শিক্ষা কি আমাদের উন্নত, মানবিক মানুষ তৈরি করতে পেরেছে? আ¤্রপালি থেকে পরীমনি। আমাদের কতটা বদল হলো? দুজনই অভিজাত শ্রেণির লালসা, লাম্পট্টের শিকার। পার্থক্য হলো আ¤্রপালির সঙ্গে চতুরতা, প্রতারণা হয়নি। আ¤্রপালির মোহ আর লোভ ছিল না। ক্ষমতা আর লালসার কাছে ঝলসে গেছে আ¤্রপালির জীবন। পক্ষান্তরে পরীমনিদের লোভ আর মোহকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষ তাদের ব্যবসায়ী পণ্যে পরিণত করে। পরীমনিদের ছলাকলা আর রূপের জালে বিত্তবানদের অপদার্থ, কামনার্ত, লোভী পুত্রদের ফাঁসিয়ে তরতর করে উপরে উঠে যায়।
আ¤্রপালির জন্য আলাদা মহল ছিল। নেশাগ্রস্ত, কামনার্ত অভিজাত শ্রেণি তার দর্শনের জন্য বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করত মাসের পর মাস। সাধারণের এখানে কোনো ভূমিকা ছিল না। বর্তমানে সমস্যা হলো অভিজাতের অন্যায়ে সাধারণরা জড়িয়ে পড়ে। মাথা নিয়োগ করে। আমাদের জীবন যখন ডেঙ্গু আর করোনার ছোবলে বিধ্বস্ত, শিশুরা অকালে এতিম হচ্ছে, অল্প বয়সে বিধবা হচ্ছে নারীরা, সংসারের একমাত্র রোজগারের ব্যক্তি মৃত্যুতে পথে বসছে পরিবারগুলো, তখন সারা দেশের মাথা নিয়োগ হলো মডেলদের মদ আর শয্যাসঙ্গীদের নিয়ে নিউজে। রাতারাতি সবাই মহামানব সেজে গেল। পরীমনি কতটা খারাপ সেটা বলতে গিয়ে নিজেদের পীর, দরবেশের ভূমিকায় নিয়ে এলেন। রাস্তা দিয়ে সাধারণদের মাইক্রোবাস দিয়ে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়ার সময় জোর করে নারীর সাথে ছবি তুলে সে ছবি দিয়ে বস্ন্যাকমেইল করার তথ্য কি পুলিশের কাছে নেই? সাধারণের জীবনের এসব সমস্যার সমাধান নেই। অবৈধ উপার্জনের অভিজাতের বখে যাওয়া পুত্ররা এবং অবৈধ উপার্জনের বিত্তবানরা স্ত্রী রেখে যখন দামি উপহার নিয়ে পরীমনিদের মতো মডেলদের বাড়িতে মদের আড্ডায় পড়ে থেকে ফেঁসে যাচ্ছিলেন তখন তাদের রক্ষার্থে এসব সুন্দরীদের ধরা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। কয়টা পরী ধরবে আইন-আদালত?
ইতিহাস বলে মোঘল স¤্রাজ্য ধ্বংসের জন্য দায়ী ছিল মদ এবং বাইজি। অনেক বড় বড় রাজা মহারাজার ধ্বংসের নেপথ্যেও দায়ী এই মদ এবং নারী। আমরা সাধারণ মানুষ। উপর তলার মদের দুর্গন্ধ আর সুন্দরী নারীর নূপুরের ঝংকার আমাদের ভাঙা ঘরে না পৌঁছালেই আমরা খুশি। রাতের আঁধারে মদে ডুবে থেকে যে পুরুষ ভৃত্যের মতো অনুগ্রহের জন্য অপেক্ষা করে, লাথি খেয়েও পায়ের কাছে কুকুরের মতো ঘুরঘুর করে সে মহান সাজে দিনের আলোয়। চরিত্রহীনার তিলক আঁকে, নষ্ট নারীর উপাধি দেয়। ২৫০০ বছর পূর্বে যা হয়েছিল তাতে ক্ষমতার দম্ভ ছিল কিন্তু চতুরতা ছিল না। সাধারণ মানুষের জীবনে তা প্রভাব ফেলেনি। ২০২১ সালে যা হচ্ছে তাতে ক্ষমতার সাথে যোগ হয়েছে চতুরতা। সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে প্রতিদিনের হাজার সমস্যা থেকে তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো হচ্ছে। আফগানিস্তানকে ধন্যবাদ। এই ইস্যুটা এসেছে বলেই পরীর আছর থেকে রক্ষা পেল এদেশের জনগণ। রাতের ভৃত্যরা এবার অন্য কোনো পথে অন্য কোনো মহল খুঁজে নেবে। বড়লোকের জোয়ান পোলারা রাতের ভৃত্য হয়েই থাক। মুক্তি পাক সাধারণ মানুষ।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি কথাসাহিত্যিক কলাম লেখক ও শিক্ষক