পটুয়াখালীর লাউকাঠিতে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বাফা ) গুদাম থেকে ডিলারদের মাঝে সার সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাফার গুদামে মজুদ সার শেষ হয়ে গেছে। জেলার ডিলারদের বরিশাল বাফার গুদাম থেকে সার সরবরাহের জন্য বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করে জেলা প্রশাসক বরাবরে চিঠি দিয়েছে।
এই অবস্থায় বরিশাল থেকে সার তুলে পটুয়াখালীর কৃষক পর্যায়ে সঠিক সময়ে সার পৌছানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে এবং চলতি আমন আবাদ ও উৎপাদন বিঘিœত হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন পটুয়াখালী শাখার নেতৃবৃন্দ। সংগঠনের পক্ষ থেকে জেলার বাফার গুদামের কার্যক্রম বন্ধ না করার জন্য বিসিআইসি’র চেয়ারম্যান বরাবরে চিঠি পাঠিয়েছে।
পটুয়াখালীর সার ডিলারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, জেলায় মোট ৭৮ জন সারের ডিলার রয়েছে। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এই ডিলাররা পটুয়াখালীর বাফার গুদাম থেকে তাদের বরাদ্দের সার সরবরাহ করে আসছিল। কিন্তু গুদামটি পুরোনো এবং ব্যবহারে অনুপযোগি হওয়ায় কথা জানিয়ে গুদামের কার্যক্রম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ডিলাররা আরো জানান, বরিশাল বাফার গুদাম থেকে বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার ডিলারদের সার সরবরাহ করা হয়। চার জেলায় সার সরবরাহে সময় ক্ষেপন হয়। আবার পটুয়াখালীর ডিলাররা সেখান থেকে সার উত্তোলনে আরো চরম ভোগান্তিতে পড়বে।
পটুয়াখালী শহরের শহীদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. শহিদুল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে পটুয়াখালীর গুদামে সার শেষ হওয়ায় বরিশাল গুদাম থেকে সার উত্তোলনের উদ্যোগ নেন। ব্যাংকে টাকা জমাও দিয়েছে। কিন্তু এক চার-পাঁচ দিন হয়ে গেছে এখনও সার উত্তোলন করতে পারেন নি। আগের বরাদ্দের সার দিয়ে চলছে তার দোকান।
জেলার রাঙ্গাবালীর বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের ডিলার আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক নুরুল আমিন জানান, উপজেলাটি এমনিতেই বিচ্ছিন্ন। নৌপথ ছাড়া সার পৌছানোর কোন বিকল্প পথ নেই। বরিশাল থেকে সার উত্তোলনে সিরিয়াল দিতে হবে, সার পেতে কয়েকদিন পেরিয়ে যাবে। এরপর নদী পথে এলাকার সার পৌছানোও দেরি হবে এবং ব্যয়বহুল হবে। এতে করে সার সঠিক সময়ে পৌছানো যাবে না। কৃষকও তার প্রয়োজনের সময় সার সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়বে।
জেলার রাঙ্গাবালী উপজেলার সদর ইউনিয়নের উত্তর কাজির হাওলা গ্রামের কৃষক বায়তুন মৃধা জানান, তিনি এবছর ১০ একর জমিতে আমনের আবাদ করছেন। তার ৫০০ কেজি ইউনিয়া সার প্রয়োজন হবে। ইতোমধ্যে তিনি স্থানীয় ডিলারদের কাছ থেকে সার কিনেছেন। ডিলাররা পটুয়াখালী থেকে একদিনের মধ্যে ট্রলারে সার নিয়ে চলে আসে। তবে বরিশাল থেকে সার উত্তোলন করে নিয়ে আসতে আসতে অনেক সময় প্রয়োজন হবে। পটুয়াখালী গুদাম থাকলে কৃষক দ্রুত সময়ে সার পাবে বলে জানান তিনি।
পটুয়াখালীর বাফার গুদামের তথ্য থেকে জানা গেছে, গত বছর ১ জুলাই থেকে চলতি বছর ৩০ জুন পর্যন্ত এই গুদাম থেকে ১৮ হাজার ৬২ টন সার ডিলারদের সরবরাহ হয়েছে। আগস্ট মাসে বরাদ্দ এসেছে ৪ হাজার ৭০০ মেট্্িরট টন সার। তবে এর ৭৫ ভাগ বরিশাল গুদামে এবং ২৫ ভাগ পটুয়াখালীর গুদামে এসেছে। ২৩ আগস্ট গুদামের সার সরবরাহ শেষ হয়েছে।
বিসিআইসি’র মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মো. মঞ্জুর রেজা ২৪ জুন স্বাক্ষরিত পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক বরাবরে পাঠানো এক চিঠিতে পটুয়াখালীর বাফার গুদামটি দীর্ঘদিনের পুরোনো ও ব্যবহার অনুপযোগি। চিটাগাং ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) গুদামটি ব্যবহার উপযোগী করার জন্য মেরামত করার উদ্যোগ নিলেও গুদামটি মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করা সম্ভব নয় বিধায় গুদামের মজুদ সার সরবরাহ শেষে পটুয়াখালীর ডিলারদের বরাদ্দের সার বরিশাল বাফার গুদাম থেকে সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছে।
চিঠি পেয়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় ৮ জুলাই তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) জি.এম সরফরাজ, সদস্য সচিব পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক একেএম মহিউদ্দিন ও সদস্য পটুয়াখালী বাফার গুদাম ইনচার্জ মো. মশিউল ইসলাম। এই কমিটি বাফার গুদামের সার্বিক অবস্থা সরেজমিন পর্যবেক্ষন করে ২৮ জুলাই সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে গুদামের ছাদের কিছু অংশ দুর্বল, অতি বৃষ্টিতে কিছু কিছু অংশ দিয়ে সামান্য পানি চুইয়ে পরে। গুদাম সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মেরামত করলে গুদামটি আরো কয়েক বছর ব্যবহার উপযোগী থাকবে। ইতোমধ্যে বিসিআইসি’র গঠিত কমিটি গুদামটি মেরামতের জন্য প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বর্তমানে জেলায় আমর বীজতলা তৈরি শেষ করে রোপন কার্যক্রম চলছে। জেলায় ২ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ফলে প্রচুর সার ব্যবহার হবে এবং ডিলাররা জেলার বাফার গুদাম থেকেই সার সরবরাহ নিয়ে সহজেই কৃষকদের মাঝে পৌছাতে পারবে। ভরা আমন মৌসুমে সার সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে আমন আবাদের উপর বিরুপ প্রতিক্রিয়া পরবে। জেলা সারও বীজ মনিটরিং কমিটিও পটুয়াখালীর বাফার গুদাম থেকে সার সরবরাহের পক্ষে মতামত বক্ত্য করেছে।
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন ৮ আগস্ট বাফার গুদামের পরিদর্শন প্রতিবেদনটি বিসিআইসি এর চেয়ারম্যান বরাবরে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন।
এদিকে, সার ডিলারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন পটুয়াখালী শাখার সভাপতি মো. গোলাম সরোয়ার ও সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল আমিন জেলা বাফর গুদামের কার্যক্রম বন্ধ না করার জন্য কৃষকদের এবং সার ডিলারদের পক্ষ থেকে ৬ জুন বিসিআইসিএর চেয়ারম্যান বরাবরে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন।
ওই চিঠিতে বলা হয়, ২০০৭ সাল থেকে পটুয়াখালীর বাফার গুদামের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলে আসছে। গুদামে কিছু সমস্যা থাকলেও কখনো সার নষ্ট হয়নি। এই অবস্থায় পটুয়াখালী থেকে বাফার গুদামের কার্যক্রম বন্ধ করে জেলার সকল বিসিআইসি’র ডিলারদের বরিশাল বাফার গুদাম থেকে সার আনতে বলা হয়েছে, যা সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হবে। এর ফলে কৃষক পর্যায়ে সঠিক সময়ে সার পৌঁছানো অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
চিঠিতে আরো বলা হয়, জেলায় বাফার গুদাম স্থাপনের পর থেকে কৃষক পর্যায়ে সারের সহজলভ্যতার কারণে তরমুজ, মুগডাল, আউশ, বোরোসহ বিভিন্ন রবি ফসল উৎপাদনে সফলতা এনে দিয়েছে। কৃষিতে সফলতা ধরে রাখার জন্য কৃষক পর্যায়ে সঠিক সময়ে সার পৌছানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এতে করে চলতি আমন আবাদ ও উৎপাদন বিঘিœত হবে।