আজ ৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বের সঙ্গীত জগতে ‘সুর সম্রাট’ খ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সুদু খাঁ, মায়ের নাম সুন্দরী বেগম। ১৯৭২ সালে ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মাইহারে মদিনা ভবনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মুত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতে বিভিন্ন কর্মসূচি থাকলেও বাংলাদেশে তেমনভাবে সরকারি বেসরকারিভাবে নেই কোনো কর্মসূচি।
বিশ্বের সঙ্গীত জগতে ‘সুর সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ আজ নিজ জন্মভূমিতেই অবহেলিত। জন্মভূমিতে রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নগুলো সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে নামে বেনামে বেদখল হয়ে যাচ্ছে জমিজমা বাড়িঘর, মসজিদের জায়গা ও পুকুর। নবীনগর - শিবপুর সড়কের নাম পরিবর্তন করে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সড়ক নাম করনের দাবী জানিয়েছেন এলাকাবাসীসহ বিশিষ্টজনেরা।
জানা যায়, বড় ভাই ফকির (তাপস) আফতাব উদ্দিন খাঁর কাছে সঙ্গীতের হাতেখড়ি তার। সুরের সন্ধানে কিশোর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যাত্রাদলের সাথে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন। এখান থেকেই জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালী, কীর্তন প্রভৃতি গানের সাথে পরিচিতি লাভ করেন। তারপর কোলকাতায় যান সঙ্গীতে দীক্ষা নেয়ার জন্য।
১৯১৮ সালের পর তিনি ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৫২ সালে ভারতের সঙ্গীত আকাদেমি পুরস্কার পান। ১৯৫৪ সালে আকাদেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে ‘পদ্মভূষণ’ ও ১৯৭১ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ১৯৬১ সালে তিনি বিশ্বভারতী কর্তৃক দেশি ‘কোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। ভারতের দিল্লি ও বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে আজীবন সদস্যপদ দান করেন। শান্তি নিকেতনে আমন্ত্রিত অধ্যাপক হিসেবে কিছুকাল অধ্যাপনা করেন।
তিনি বাঁশি, পিকলু সেতার ম্যাডোলিন ব্যাঞ্জু, সানাই, নাকাড়া, তবলা ও সরোদসহ আরো বিভিন্ন যন্ত্র বাজানো শেখেন। সঙ্গীত জীবনে তিনি বড় ভাই ফকির আফতার উদ্দিন, ননো গোপাল, অমৃত লাল দত্ত, লবু সাহেব, অমর দাস, হাজারী ওস্তাদ, ওস্তাদ আহাম্মদ আলী খাঁ, তানসেন বংশীয় বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁসহ আরো অনেকের কাছে দীর্ঘ ত্রিশ বছর সঙ্গীতের কলাকৌশল শেখেন। ওস্তাাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সঙ্গীত শেখেন তার ছেলে আলী আকবর খাঁ, মেয়ে অন্নপূর্ণা, মেয়ের জামাই রবি শঙ্করসহ আরো অনেক বিখ্যাত শিল্পীরা। তার জীবনযাপন ছিলো অতি সাধারণ। কিংবদন্তী সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৭২ সালে ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের মাইহারে মদিনা ভবনে মৃত্যুবরণ করেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতে তার মুত্যুবার্ষিকী পালন করা হলেও নিজ জন্মভূমিতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে থাকে না কোন কর্মসূচি।
শিবপুরে ওস্তাদ পরিবারে আরো জন্মগ্রহণ করেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বড় ভাই ‘মলয়া’ গানের সুর স্রষ্টা ফকির তাপস আফতাব উদ্দিন খাঁ, ছোট ভাই সুরসাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, সুরকার শেখ সাদী খান, রাজা হোসেন খান, সরোদ শিল্পী ওস্তাদ শাহাদাৎ হোসেন খানসহ বহু সঙ্গীত সাধক।
সরজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে বাড়িটিতে সপরিবারে বসবাস করেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বড় ভাই ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর মেয়ের বংশধর ইদ্রিস খান। ৬৩ বছর বয়স্ক ইদ্রিস খান বলেন, আমি অসুস্থ, সে কারণে খাঁ সাহেবের মৃত্যু বার্ষিকীকে কোন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারছিনা। তিনি বাড়ির উত্তর পূর্বকোণে দুটি অরক্ষিত কবর দেখিয়ে দুঃখ করে জানান, আলাউদ্দিন খাঁর বাবা সবদর হোসেন খাঁ (সদু খাঁ) ও মাতা সুন্দরী খানমের শত বছরের পুরনো বিধ্বস্থ ওই দুটি কবরই এখনও এই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে ওস্তাদ পরিবারের সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্ন। সংস্কারের অভাবে পুকুরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নিরাপত্তা বেষ্টনি না থাকায় কবরের উপর কুকুরসহ বিভিন্ন জীবজন্তু এসে অত্যাচার করে। আলাউদ্দিন খাঁর জমিজমা বাড়িঘড়, মসজিদের জায়গা ও পুকুর বেদখল হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির কিছু অংশ পুকুরে বিলিন হয়ে যাচ্ছে।
আশির দশকে কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক শিবপুর এসে দেশি বিদেশি সঙ্গীত পিপাসুদের জন্য আলাউদ্দিন পল্লীতে একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। যেখানে স্থান পাওয়ার কথা ছিল ফকির (তাপস) আফতাব উদ্দিনের মাজার, সুর সম্রাটের নামে মিউজিয়াম, সঙ্গীত একাডেমি, পাঠাগার, মিলনায়তন, মুক্তমঞ্চ, পিকনিক কর্ণার ও অতিথিশালা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পরবর্তিতে আলাউদ্দিন খাঁ পরিবারের পক্ষ থেকে ২২ শতক জমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসকের নামে দলিল রেজিস্ট্রি করে দেয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।
স্থানীয়রা জানান, শিবপুরে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নিজ হাতে ১৮৯৮ সালে তৈরি একটি মসজিদ, পুকুর, বড় ভাই আফতাব উদ্দিন খাঁর মাজার, সুর সম্রাটের মা-বাবার কবর ও তার পৈত্রিক ঐতিহাসিক বাড়িটিসহ কোনো স্মৃতিচিহ্নই এখন পর্যন্ত সরকারীভাবে সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সেখানে নতুন করে রাস্তা তৈরির নামে আলাউদ্দিন খাঁ পরিবারের পূণ্যভূমিখ্যাত ওই বাড়িটিকে ধ্বংস করার সরকারি এই পরিকল্পনা কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। নবীনগর -শিবপুর সড়কের নাম পরিবর্তন করে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সড়ক নাম করনের দাবী জানাচ্ছি।
এলাকাবাসীর সহযোগিতায় শিবপুর আলাউদ্দিন খাঁর বাড়ির পাশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ মহাবিদ্যালয়। নবীনগর উপজেলা সদর থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত শিবপুর নামক গ্রামটিতে এখনো যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই নাজুক।
এ বিষয়ে নবীনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একরামুল সিদ্দিক বলেন, ‘ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ শুধু নবীনগর কিংবা ব্রাহ্মণবাড়ীয়ারই গর্ব নয়, তিনি সারা বাংলাদেশের গর্ব। তাকে নিয়ে অবশ্যই কিছু করার পরিকল্পনা আছে। এসব বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করব। তার বাড়ি, মসজিদ ও পৈত্রিক ভিটা সংরক্ষণের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং তার মুত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ মহাবিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল মোহাতার হোসেন চৌধুরী বলেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের মুত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে কলেজের পক্ষ থেকে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।