গোয়ালন্দ উপজেলার দেশের বৃহত্তম দৌলতদিয়া যৌনপল্লীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে অবৈধ যৌনউত্তেজক ওষুধের রমরমা ব্যবসা। অনুমোদনহীন ক্ষতিকর এসকল ওষুধ সেবন করে প্রতিনিয়ত ঘটছে প্রাণহানি। গত শুক্র ও শনিবার এধরনের ওষুধ সেবন করে ২ জনের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
গত শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর) দৌলতদিয়ায় রিমন বিশ্বাস (৪৫) নামের এক ব্যাক্তির মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সে মাগুরার মোহাম্মদপুর থানার জাঙ্গালিয়া মুসল্লী পাড়ার খোকন বিশ্বাসের ছেলে। নিহত ব্যাক্তির চাচাতো ভাই মনিরুল ইসলাম জানান, রিমন এনাম মেডিকেল হাসপাতালের গাড়ি চালক ছিলেন। করোনায় চাকরি ছেড়ে নিজ এলাকায় ব্যবসা শুরু করে। গত শুক্রবার তারা এনাম মেডিকেল হাসপাতালে একজনের সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরছিলেন। শনিবার ভোর ৩টার দিকে দৌলতদিয়া ঘাটে এসে রিমন তাকে বসিয়ে রেখে কোথায় যেন যায়। সেখান থেকে ঘন্টা খানেক পর ফিরে এসে তাকে বলেন, আমার ভালো লাগছে না। এই কথা বলেই মাটিতে লুটিয়ে পরে। দ্রুততার সাথে আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি মারা যান। প্রাথমিক ভাবে সংশ্লিষ্টরা ধারনা করছেন যৌনউত্তেজক ওষুধ সেবনের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে গত শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) দেলোয়ার হোসেন বাবু (৫০) নামের এক ব্যাক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। তার বাড়ি ঢাকার ওয়ারি এলাকায়। তিনি পেশায় একজন ইলেকট্রনিক ব্যাবসায়ী। অবৈধ যৌন উত্তেজক ওষুধ সেবনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ ও স্থানীয়দের ধারনা।
পুলিশ ও যৌনপল্লী সূত্রে জানা যায়, দেলোয়ার হোসেন শুক্রবার ভোর ৪ টার দিকে যৌন উত্তেজক ওষুধ সেবন করে যৌনপল্লীর আনোয়ারা বাড়ীয়ালীর ভাড়াটিয়া জোসনা (২৫) নামে এক যৌনকর্মীর ঘরে যায়। এ সময় তার ব্লাড প্রেশার বেড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভোর ৫ টার দিকে তার অবস্থা বেশি গুরুতর হয়ে পড়লে স্থানীয়রা তাকে গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
খোঁজ নিয়ে জান যায়, কোন রমক নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে দৌলতদিয়া যৌনপল্লী এলাকায় বিক্রি হয় অবৈধ যৌনউত্তেজক ওষুধ। বিভিন্ন ওষুধের দোকান ছাড়াও মুদি দোকান, পান-সিগারের দোকানেও খুব সহজেই পাওয়া যায় প্রাণঘাতি ক্ষতিকর এ ধরনের ওষুধ। কম দামে ও সহজে কিনতে পেরে যৌনপল্লীতে আসা মানুষ অহরহ এসব ওষুধ সেবন করে থাকে। এতেকরে প্রাণহানি ছাড়াও শরীরে সৃষ্টি হয় দীর্ঘমেয়াদী নানা জটিল রোগ।
অপরদিকে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক কিশোরী ও ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের মেয়েদের বিভিন্ন ক্ষতিকর ওষুধ সেবনের মাধ্যমে মোটা স্বাস্থ্যবান করার অভিযোগ রয়েছে। এতে তারা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি অনেকেই অকালে মৃত্যু বরণ করছে। দৌলতদিয়া যৌনপল্লীকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নানা ভাবে ফুসলিয়ে এবং অপহরণ করে অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক এবং দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের এ পল্লীতে এনে যৌনপেশায় বাধ্য করে। এদের বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় তাদের রুগ্ন স্বাস্থ্য। ফলে এ সকল মেয়েদের দ্রুত স্বাস্থ্যবান ও আকর্ষনীয় করে গড়ে তুলতে তাদেরকে বিভিন্ন ট্যাবলেট ও ইনজেকশন গ্রহনে বাধ্য করা হয়। এ জাতীয় ওষুধ ও ইনজেকশন গ্রহনের ফলে মেয়েদের মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে ভোগার পাশাপাশি প্রায়ই এখানে মেয়েদের অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে এ কারণে। এ ধরণের ওষুধ বিক্রিকে কেন্দ্র করে যৌনপল্লী ও এর আশপাশে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অর্ধশত ওষুধের দোকান। এ সকল ওষুধের দোকান ছাড়াও অন্যান্য দোকানেও বিক্র করা হয় বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ওষুধ।
দৌলতদিয়া যৌনপল্লী এলাকায় যৌনউত্তেজিত ওষুধ হিসেবে হর্সফিলিম, জিনসিন, সেনেগেরা ১০০ এমজি, একগিরা ১০০ এমজি সহ বিভিন্ন নামের ওষুধ বিক্রি হয়ে থাকে। এগুলো সাধারনত যৌনপল্লীর ভেতরে ও গেটে পান-সিগারের দোকান, মুদি দোকানসহ ওষুধের দোকানে বিক্রি হয়। এ ছাড়া ওরাডেক্সন গ্রুপের ওষুধ ও ইনজেকশন সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও শরীর মোটা করার জন্য প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আসিফ মাহমুদ জানান, কোন ওষুধই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় ও সেবন অবৈধ। দৌলতদিয়া যৌনপল্লী এলাকায় যে সকল যৌনউত্তেজক ওষুধ হিসেবে বিক্রি করা হয়, এ ওষুধ গুলোর নাম শুনে আমার কাছে অপরিচিত লাগছে। এ ওষুধ সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারনা নেই। তবে ওরাডেক্সন গ্রুপের যে ওষুধ সেবস করা হয় এটা মূলত হাপানি, এ্যজমা, গিরা ব্যাথা, রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে সাধারনত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাধারনত এ ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রোগীর বয়স, ওজনসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে মাত্রা নির্ধারন করা হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ জাতীয় ওষুধ ব্যবহারকারীর মস্তিষ্ক বিকৃতি, উচ্চ রক্তচাপ, স্মরন শক্তি লোপ পাওয়া, ডায়াবেটিকস, হার্টের মাংশ পেশি বেড়ে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা, লিভার সমস্যা, কিডনি ফেইলর, শরীরে পানি জমে যাওয়া, চর্মরোগসহ ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
দৌলতদিয়া খান মেডিসিন স্টোরের মালিক জয়নদ্দিন খান এ সকল ওষুধ তিনি বিক্রি করেন না বলে দাবি করে জানান, তিনি শুধু অনুমোদিত ওষুধ বিক্রি করে থাকবে। ডাক্তারের ব্যবাস্থা পত্র না থাকলেও অনেক সময় ওষুধ বিক্রি করেন বলে স্বীকার করে জানান, ওই সব অবৈধ ওষুধ কোন কোন ফার্মেসী বিক্রি করলেও বেশীর ভাগ ওষুধ যৌনপল্লীর অন্যান্য দোকানে বিক্রি হয়ে থাকে।
ফরিদপুর ওষুধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক বাদাল শিকদার তাদের লোকবল সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করে জানান, বিষয়টি নিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে এ ধরনের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করা সহ এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা হবে।
গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা ডা. নিতাই কুমার বলেন, সাধারনত এ ধরনের ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে রোগীর বয়স, ওজনসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে মাত্রা নির্ধারন করা হয়। আর অবৈধভাবে যারা এ ওষুধ সেবন করে তারা একসাথে ৪/৫টি ট্যাবলেট খায়। এতেকরে তাদের ব্লাডপ্রেসার বেড়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ জাতীয় ওষুধ ব্যবহারকারীর মস্তিষ্ক বিকৃতি, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের মাংশ পেশি বেড়ে রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা, লিভার সমস্যা, পুরুষের প্রজন ক্ষমতা হ্রাস, কিডনি ফেইলর, শরীরে পানি জমে যাওয়াসহ ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ জাতীয় ওষুধ গ্রহন করা কোন ভাবেই উচিত নয়। তিনি আরো বলেন, দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় অবৈধভাবে ক্ষতিকর ওষুধ বিক্রি বন্ধে ইতোমধ্যে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে অভিযানের খবর পেলে অনেকেই দোকান বন্ধ করে পালিয়ে যান অথবা এ জাতীয় ওষুধ সরিয়ে ফেলেন। তাই এ জাতীয় ওষুধ বিক্রি বন্ধে স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল তায়াবীর জানান, প্রাথমিক ভাবে আমাদের ধারনা অতিরিক্ত যৌন উত্তেজক ওষুধ সেবনের কারণে পরপর দু’টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ময়না তদন্ত শেষ করে দু’টি লাশ নিজ নিজ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তিনি আরো জানান, অবৈধ ওষুধ বিক্রি বন্ধে পুলিশের কাজ করার সুযোগ কিছুটা কম। এ ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসনের কাজ করার সুযোগ বেশী। ওষুধ প্রশাসন কোন উদ্যোগ নিলে তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিজুল হক খান মামুন জানান, যৌনপল্লী কেন্দ্রীক বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ওষুধ বিক্রি বন্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে গত শনিবার স্থানীয় মুক্তি মহিলা সমিতির সম্মেলন কক্ষে ওষুধ বিক্রেতা ও অন্যান্য দোকানদারদের উপস্থিতিতে সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। এ ছাড়া এদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চলমান আছে। আগামীতে এই অভিযান আরো জোরদার করা হবে।