কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে সমাজসেবা অফিস কর্তৃপক্ষের অনিয়মের শিকার হয়ে বিভিন্ন ভাতা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে আসা নারী-পুরুষেরা ভাতার দাবিতে অনশন করেছেন। উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডের নানা বয়সী প্রায় অর্ধশত ভাতার কার্ডধারী নারী-পুরুষ গত মঙ্গলবার সকাল থেকে উপজেলা সমাজসেবা অফিসে অবস্থান নিয়ে অনশন শুরু করেন। দিনভর অনশন করলেও এসব অসহায় মানুষের খোঁজ নেননি কেউ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তারের দুই দফা হস্তক্ষেপের পর ভাতা বঞ্চিত অনশনকারীরা মঙ্গলবার গভীর রাতে অনশন প্রত্যাহার করে সেখান থেকে নিজেদের বাড়ি ফিরে যান।
অনশনকারীরা জানান, গত এক বছর ধরে তারা বিভিন্ন ভাতার টাকা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাসহ নানা জায়গায় ধরনা দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। তাদের প্রত্যেকের নামে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড থাকা সত্ত্বেও সমাজসেবা কর্মকর্তার নির্দেশে ওই অফিসের কর্মচারীরা ভাতার টাকা প্রদানে গড়িমসির আশ্রয় গ্রহণ করে তা আত্মসাৎ করে আসছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তারা ভাতা পেয়েছেন। এরপর নগদের মাধ্যমে ভাতা দেয়া শুরু হলে তাদের অ্যাকাউন্টে খোলার সময় মোবাইল নম্বর জালিয়াতি করে দেয়ায় গেল এক বছর ধরে এসব ভাতা প্রাপ্তি থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত রয়েছেন।
এ কারণে ভাতা বঞ্চিতরা তাদের এসব ন্যায্য ভাতার দাবিতে সমাজসেবা অফিসে আমরণ অনশন করার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মঙ্গলবার সকাল থেকে উপজেলার পিয়ারপুর ইউনিয়নের পুরাতন আমদহ গ্রামের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা বঞ্চিত বিভিন্ন বয়সী প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষ অনশন শুরু করেন। তাদের মধ্যে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী অসুস্থ হয়ে পড়লে অন্যরা সন্ধ্যায় তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। তবে এই গরিব, অসহায় মানুষগুলো দিনভর অফিসটিতে অনশন করে আসলেও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের খোঁজখবর পর্যন্ত নেননি বলে তারা জানান।
দিন শেষে সন্ধ্যা অতঃপর রাত নেমে আসলেও তারা অনশন চালিয়ে আসায় অবশেষে তাদের অনশন ভাঙাতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার রাতে দুই দফা সমাজসেবা অফিসে যান। প্রথম দফায় রাত ৯টার দিকে ইউএনও ওই অফিসে গিয়ে তাদের অনশন ভাঙানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। নিজেদের ন্যায্য দাবি আদায়ের বিষয়ে ইউএনওর কথায় আশ্বস্ত হতে না পেরে অনশনকারীরা তাদের এই অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। এরপর রাত ১১টার দিকে পুনরায় ইউএনও শারমিন আক্তার সমাজসেবা অফিসে গিয়ে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ভাতা বঞ্চিতদের সকল সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়ায় তারা অনশন প্রত্যাহার করে সেখান থেকে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যান।
এ বিষয়ে পিয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবু ইউসুফ লালু সাংবাদিকদের জানান, সমাজসেবা অফিসের মাঠ পর্যায়ের কিছু অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে ভাতাভোগীদের নগদ অ্যাকাউন্টের মোবাইল নম্বর গরমিল করে এসব ভাতার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। শুধু তার ইউনিয়নেই নয়, ওই চক্রটি বিভিন্ন ইউনিয়নের গরিব, অসহায় মানুষের বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে জানিয়ে তিনি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেন।
এদিকে মঙ্গলবার দিনভর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আতাউর রহমানকে অফিসে পাওয়া যায়নি। গভীর রাত পর্যন্ত ভাতা বঞ্চিতরা অফিসটিতে অনশন করলেও সমাজসেবা কর্মকর্তার দেখা মেলেনি। একটি সূত্র জানায়, দিনের বেলায় কুষ্টিয়া জেলা সমাজসেবা অফিসে মিটিংয়ে ছিলেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আতাউর। তবে মিটিং শেষে তিনি অনশনের খবর পেয়েও নিজ দপ্তরে না এসে সরাসরি বাসায় চলে যান। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া যায়।
বুধবার সমাজসেবা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনিয়মের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে তারা বেশকিছু অসঙ্গতি পেয়েছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তর, কুষ্টিয়ার উপ-পরিচালক রোখসানা পারভিন সাংবাদিকদের জানান, ইতোমধ্যে পাঁচ শতাধিক ভাতাভোগীর বিষয়ে অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। যারা ভাতা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের ভাতার টাকা ফিরিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ভাতা বঞ্চিতদের পুরো বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হবে। একই সঙ্গে এসব অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, দৌলতপুর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ভাতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে নানা অনিয়ম দুর্নীতি চলে আসলেও কিছুতেই এর প্রতিকার মিলছে না। এক কর্মকর্তা যান আরেক কর্মকর্তা আসেন। কিন্তু অনিয়ম দুর্নীতির আগ্রাসন মুক্ত হয় না দপ্তরটি। এই দপ্তরকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দালাল সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের লোকজন অসহায় মানুষদের বিভিন্ন ভাতার কার্ড করে দেয়ার নামে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। অনেকে ভাতার কার্ড পাওয়ার আশায় ধারদেনা করে দালালদের হাতে টাকা তুলে দিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। তারা দিনের পর দিন অফিসে ধরনা দিয়েও কাক্সিক্ষত কার্ড পাচ্ছেন না। সমাজসেবা কর্মকর্তার মদতে দালাল চক্রের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।
ভাতা বঞ্চিতদের অনশনের ঘটনা সম্পর্কে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি যদিও আমার নয়, আমি এই কমিটির একজন সদস্য মাত্র। তারপরেও ভাতা বঞ্চিতদের অনশন ভাঙাতে রাতে দুই দফা সমাজসেবা অফিসে যাই। রাত ১১টার দিকে নানাভাবে বুঝিয়ে আশ্বস্ত করার পর অনশনকারীদের বাড়ি ফেরানো হয়। খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসে বিষয়টি সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।