দেশব্যাপি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হচ্ছে আগামীকাল (১২ সেপ্টেম্বর)। এ উপলক্ষে কুড়িগ্রামের ৯ উপজেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে করোনা মোকাবেলায় শিক্ষাবান্ধব এবং স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ গঠনে চলছে বিভিন্ন কর্মকান্ড। কিন্তু স্কুল ভেঙ্গে যাওয়া, বন্যায় ডুবে যাওয়াসহ নানা কারণে প্রায় ১০৫ বিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
চলতি বন্যায় নদী ভাঙ্গনে বিলিন হয়েছে ১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে ১৫টি বিদ্যালয়। আর বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে পাঠদানের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে ৮০টি বিদ্যালয়। এর মধ্যে কয়েকটি স্কুলের পানি কমে গেলেও পাঠদানের পরিবেশ ফিরে আসেনি। মাঠ পর্যায় থেকে এসব হিসাব পাওয়া গেলেও সরকারি দপ্তরে সঠিক কোন তথ্য নেই। ফলে তারা বলতে পারছে না স্কুল খুললেও কত সংখ্যক শিক্ষার্থী ঠিক এই সময়ে যেতে পারবে না।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলায় করোনাকালীন সময়ে ১৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। ভাঙ্গনের মুখে ১৫টি এবং বন্যাকবলিত আছে ৪৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
অথচ চলতি বছর উলিপুর উপজেলায় ৩টি, রৌমারীতে ৪টি ও রাজারহটে ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। কুড়িগ্রামে তীব্র নদীর ভাঙ্গনে বিলিন হচ্ছে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। হুমকির মুখে রয়েছে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফলে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে হাজারো শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঠিক সংখ্যা নিয়ে রয়েছে শিক্ষা বিভাগে ভিন্ন মত।
দেশের উত্তরের বৃহৎ নদ-নদী বেষ্টিত জেলা কুড়িগ্রামে রয়েছে ১৬টি নদ-নদী। চলতি বর্ষা মৌসুমে বন্যার তেমন প্রভাব না পড়লেও থেমে নেই ভাঙ্গনের তীব্রতা। এতে করে প্রতিদিনই বিলিন হচ্ছে ঘরবাড়ি আর ফসলি জমির পাশাপাশি একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নদীর পানি বৃদ্ধি-হ্রাসের সাথে ভাঙ্গন আরও ভয়াবহ রূপ নেয়ায় হুমকিতে পড়েছে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার এবং গঙ্গাধর নদী গর্ভে গেছে ৪ উপজেলার ৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেগুলো হলো-উলিপুর উপজেলার পশ্চিম বজরা, চেরাগের আলগা, বগুলা কুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। নাগেশ্বরীর-আকবর আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রাজারহাটের গতিয়াশাম বগুড়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রৌমারীতে-গত বছর ভাঙ্গনের শিকার হয়ে স্থানান্তরিত হলে চলতি বন্যাতেও ফলুয়ার চর এবং ঘুঘুমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আবারও ভাঙ্গনের শিকার হয়। এছাড়াও ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ৭টি উপজেলার ২২টি বিদ্যালয়। এরমধ্যে ভূরুঙ্গামারীতে-১১টি, রাজিবপুরে-৩টি, উলিপুরে-২টি এবং সদর, নাগেশ^রী, রাজারহাট, চিলমারী একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ উলিপুরে-১টি মাদরাসা এবং ১টি উচ্চ বিদ্যালয়।
ভাঙনের কবলে পড়া স্কুলগুলোর মালামাল পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। স্কুল নির্মাণের জমি না পাওয়ায় কোমল মতি শিশুদের লেখাপড়া নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। বিলিন হওয়া স্কুল নির্মাণের জন্য নতুন করে জমি না পাওয়ায় দুশ্চিন্তায় শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য বালু ভর্তি জিও ব্যাগ এবং জিও টিউব ফেলা হলেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না ভাঙ্গনের তীব্রতায়। বিলিন হওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে কোন স্কুল না থাকায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর লেখাপড়া নিয়ে অনিশ্চতায় পড়েছেন অভিভাবকরা। করোনায় দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত। অপরদিকে নদী ভাঙ্গনে বিদ্যালয় বিলিন হয়ে যাওয়া সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তায় অভিভাবক মহল।
সরেজমিনে দেখাযায়, ভূরুঙ্গামারী ২নং পাইকেরছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দুধকুমার নদীর ভাঙ্গন থেকে মাত্র ২০ফুট দূরে রয়েছে। বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র সবকিছুই জরাজীর্ণ অবস্থায় তালা বদ্ধ হয়ে পড়েছে। কোন শিক্ষকের নেই খোঁজখবর।
ওই এলাকার বাসিন্দা জলিল মিয়া বলেন, ‘এই স্কুল ভেঙ্গে গেলে আমার সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার যদি দ্রুত ভাঙ্গন রোধে স্থায়ী ব্যবস্থা না নেয় তাহলে স্কুলও ভাঙ্গবে পাশাপাশি গ্রামটাও বিলীন হবে।’
নাগেশ^রী উপজেলার ১১৮বছর বয়সের রঘুরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও গঙ্গাধর নদীর ভাঙ্গনের মুখে পড়েছে। শতবর্ষের উপর এই বিদ্যালয় থেকে নদী মাত্র ৫০মিটার দূরে রয়েছে। দ্রুত ভাঙ্গন রোধে কার্যকরি পদক্ষেপ না নিলে বিদ্যালয়টি যেন কোন মূহুর্তে বিলিন হবার শংকা রয়েছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লস্কর আলীর বলেন,স্কুল ঘর ভেঙ্গে সরঞ্জামাদি বাড়ির আঙিনা এবং রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত স্কুল পূর্ণ নির্মাণের জায়গা না পাওয়ায় স্কুলটি র্নিমাণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
নাগেশ^রী উপজেলার বল্লভের খাস ইউপি চেয়ারম্যান আকমল হোসেন বলেন, প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলিন হয়ে গেলে সন্তানদের পড়ালেখা বন্ধ হবে এবং অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার শংকা করেন তিনি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেন, ভাঙনে বিলীন স্কুলগুলো পুনর্নিমানের জন্য স্থানীয়ভাবে জায়গা নির্ধারণের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি ভাঙনের মুখ পড়া স্কুলগুলো রক্ষার জন্য জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দেয়া হয়েছে। আর স্কুল খুলে দেয়ার ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষা বিভাগের সকল কর্মকর্তাকে কমপক্ষে ৫টি করে বিদ্যালয় পরিদর্শনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যথাযথ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষকগণকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শামছুল আলম বলেন, চলতি বন্যায় এখন পর্যন্ত মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা বিলিন হয়নি এবং নদী ভাঙ্গনের ঝুঁকিতেও নেই। জেলার মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ মিলে ৩৭৪টি এবং ২২২টি মাদ্রাসা প্রস্তুত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। ১২ তারিখ স্কুল খোলার প্রস্তুতি হিসেবে ১০, ১১ তারিখ ছুটি ভোগ না করে সবাই কাজ করে যা্িচ্ছ। আলাদা মনিটরিং কমিটি করা হয়েছে যাতে নির্বিঘেœ বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়।