প্রয়োজনীয় মূলধন, সরকারী পৃষ্টপোষকতা, উৎপাদন পদ্ধতি আধুনিকায়ন, সুতার পর্যাপ্ত সরবরাহের অপ্রতুল ও দাম বৃদ্ধি, যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও বাজারজাত করণে নানা প্রতিকূলতায় এগিয়ে যেতে পারছে না মনিপুরী তাঁত শিল্প। সরকার তাঁত শিল্পকে এগিয়ে নিতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহন করলেও সংশ্লিষ্টদের নানা অনিয়মে তাঁতীদের কোন উপকার হচ্ছে না। উল্টো অলাভ জনক প্রতিষ্টানে পরিনত হচ্ছে এই শিল্পটি। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মনিপুরী তাঁত শিল্পীদের কল্যানের জন্য ১৯৮২ সালে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়নে স্থাপিত হয় বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড নামে এই সরকারী প্রতিষ্টান। কিন্তু এখনও প্রতিষ্টানটিতে লোকবলের অভাব সহ নানা সমস্যা রয়েছে। বর্তমানে তাঁত বোর্ডের অধীনে সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৫শ ৭১টি তাঁত শিল্প রয়েছে এবং এই শিল্পের সাথে জড়িত আছেন প্রায় আড়াই হাজার তাঁতী। সরকার তাঁত শিল্পকে এগিয়ে নিতে তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে মনিপুরী তাঁতীদের মধ্যে ঋণ সুবিধা চালু করেছেন। বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত তাঁতীদের ঋণ দেয়ার জন্য বিগত ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৯৪টি গ্রুপে ২৯টি ঋণ প্রদানকৃত সমিতি গঠন করা হয়। এইসব সমিতির মাধ্যমে গত অর্থ বছর পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে কমলগঞ্জে ১,১১৩ জন তাঁতীর মধ্যে ৯৭৫ জন, কুলাউড়ায় ১৩ জনের মধ্যে ১২ জন, জুড়ীতে ১২০ জনের মধ্যে ১১৮ জন, সিলেট বন্দরবাজার ২১৪ জনের মধ্যে ২১৩ জন এবং আম্বরখানা এলাকায় ১১১ জনের মধ্যে ১০৮ জন তাঁতীকে ঋণ দেয়া হয়েছে। ৫ জনের একটি গ্রুপে প্রথম পর্যায়ে মাথাপিছু ১০ হাজার করে ৫০ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করা হয়। এই ঋণ পরিশোধের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ হাজার করে ১ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। সরেজমিনে মাধবপুর তাঁত বোর্ড ও পার্শ্ববর্তী বাঘবাড়ি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি মনিপুরী বাড়িতে বাঁশ ও কাঠের তৈরী তাঁত দ্ধারা আকর্ষনীয় বস্ত্র তৈরী করা হয়। মনিপুরী মহিলারা এই শিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও এখন অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। বর্তমানে তাঁতের কাজ করে মনিপুরী মহিলারা অধিকাংশই নিজেদের ব্যবহারের জন্য শাড়ি, জামাকাপড় উৎপাদন করছেন। তাদের উৎপাদিত বস্ত্রের মধ্যে মনিপুরী শাড়ী, বিভিন্ন প্রকার চাঁদর, বেড কাভার, ওড়না, গামছা ও ব্যাগ উল্লেখযোগ্য। তাঁত শিল্পী মিনতি সিনহা, শিউলী রানী সিনহা বলেন, আগের মতো তাঁতে কাজে হয় না। যারা ঋণ আনছে তারা সবাই তাঁতের কাজ করে না। অন্য খাতে ঋনের টাকা ব্যবহার করছে। আগে সুতার দাম কম ছিল। তিন বছর আগেও ১শ’ টাকায় মনিপুরী পরিবারের ৪ হাতের একটি কাপড় উৎপাদন করা যেত। আর এখন পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচশ’ টাকা লাগে। এ ধরণের একটি কাপড় উৎপাদন করতে চারদিন সময় লাগে। আর এতে মজুরিটাই তাদের লাভ। তারা আরও বলেন, কাঁচামাল, সুতা ও পুঁজির অভাব, সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের অভাব ছাড়াও সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাজারজাত করার সুবিধা নেই। রাসপূর্নিমা উপলক্ষে কমলগঞ্জের মাধবপুর ও আদমপুর মন্দির প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত মেলায় অনেক দোকান বসে, কিন্তু আশানুরূপ বিক্রি হয় না। তাই এখন উৎপাদন করা হয় নিজেদের ব্যবহারের জন্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মনিপুরী জানান, তাঁত বোর্ডে কর্মরত কর্মকর্তারা যাচাই বাছাই না করে ইচ্ছে মতো ঋণ দিচেছন। একই পরিবারে পাঁচটি নাম দিয়ে ৫০ হাজার থেকে ১লাখ টাকা ঋণ নিচেছন। অথচ এই টাকা নিয়ে অন্য খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকৃত তাঁতীরা ঋণ পেলে মনিপুরী সম্ভাবনাময় তাঁত শিল্প অনেকটা এগিয়ে যেত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধবপুরের তাঁত বোর্ডের জনৈক কর্মকর্তা বলেন, কিছু সংখ্যক তাতি গ্রুপ শিল্পের নামে ঋণ নিয়ে অন্য ব্যবসায় বিনিয়োগ করছেন ও পারিবারিক চাহিদা মিটাচ্ছেন। যার ফলে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাঁত বোর্ডের লিয়াজো কর্মকর্তা জানান, ঋণ বিতরণে কোন অনিয়ম বা স্বজনপ্রীতির সুযোগ নেই। নিয়ম নীতি মেনেই ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।