আশ্বিনের বৃষ্টিতে ডুবেছে সাতক্ষীরায় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পানিতে থৈ থৈ করছে জেলার সাত উপজেলার এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। দীর্ঘ দেড় বছর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছিল চলতি মাসের ১২ তারিখে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। স্কুল খোলার আনন্দে মেতে উঠেছিল শিক্ষার্থীরা। নতুন করে নিচ্ছিল প্রস্তুতি। কিন্তু সেই আনন্দে এবার ছাঁই দিয়েছে আশ্বিনের বৃষ্টি। রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাতের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে জেলার সাত উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলা সদরের ভোমরা রাশেদা বেগম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ছাপিয়ে পানি উঠেছে শ্রেণিকক্ষে। বিদ্যালয়টির নিচতলা সম্পূর্ণ পানিতে নিমজ্জিত। মাঠের কোমর পানি পার হয়ে শ্রেণিকক্ষে যাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত পানি ওঠে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের দোতলায়ও ক্লাস নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে অন্যত্র ক্লাস করানোর কথা ভাবছে শিক্ষা অফিস। কিন্তু নিকটস্থ কোন ভবন না থাকায় সেটিও আপাতত সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে, সাতক্ষীরা শহরে নারীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য একমাত্র বেসরকারি কলেজ ছফুরননেছা মহিলা কলেজ। কলেজটি বর্তমানে পানিতে ভাসছে। সামান্য একটু বৃষ্টি হলেই কলেজের শ্রেণিকক্ষে জমছে হাঁটু পানি। এই কলেজের সামনে (সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়ক) সড়ক বিভাগের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে কিছু ভূমিহীন নামধারী মানুষ পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ করে সেখানে গড়ে তুলেছেন বসত বাড়ি। ফলে সামান্য একটু বৃষ্টি হলেই কলেজের শ্রেণিকক্ষ পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। জেলা শহরের একমাত্র বেসরকারি মহিলা কলেজের এই বেহালদশা যেন দেখবার কেউ নেই। সাতক্ষীরা শহরের ইটাগাছা-বাঁকাল এলাকায় প্রতিষ্ঠিত ছফুরননেছা মহিলা কলেজ। এখানে এইচএসসি থেকে শুরু করে অনার্স পর্যন্ত ছাত্রীরা লেখাপড়া করছে। কলেজ চত্ত্বরে শুধু নয়, শ্রেণিকক্ষের ভিতরে জমে আছে হাঁটু পানি। চারিদিকে চড়ে বেড়াচ্ছে বিষাক্ত পোকা-মাকড় ও সাপ। শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাপড়-চোপড় গুটিয়ে ঢুকছে কলেজের ভিতরে। নারী শিক্ষক ও ছাত্রীরা তাদের পরিধেয় বস্ত্র গুটিয়ে মেইন ফলক দিয়ে যখন কলেজের ভিতরে প্রবেশ করছে।
ছফুরননেছা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আশরাফুন নাহার জানান, সামন্য বৃষ্টি হলেই কলেজের ভিতরে হাঁটু পানি জমছে। পানি নিস্কাশনের সব পথ বন্ধ। শিক্ষার্থীরা সাংঘাতিকভাবে কষ্ট পাচ্ছে। অফিসের যাবতীয় কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জরুরী ভাবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা দরকার। কলেজের মাঠ মাটি দিয়ে উঁচু করা প্রয়োজন। বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি আরও বলেন, জেলা শহরে নারীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য একমাত্র বেসরকারি কলেজ এটি। প্রত্যাশা করছি এই প্রতিষ্ঠানের দিকে সকলেই নজর দিবেন। কলেজের নানাবিধ সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছফুরননেছা মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সাতক্ষীরার বিশিষ্ট সমাজসেবক আবদুল মুতালেব বিগত ২০০২ সালে মারা যাওয়ার পর অধিকাংশ সময় ক্ষমতাসীন দলের জেলার শীর্ষ প্রভাবশালী নেতারাই কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কলেজের ঠিক সামনে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যাপারে কলেজ প্রশাসন বার বার সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও অজ্ঞাত কারণে কোন পদক্ষেপই নেননি তারা। সাতক্ষীরা জেলা শহরের নারীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য একমাত্র বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান সভাপতি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির। ছাত্রীদের দাবি, কলেজের এসব দুর্ভোগ লাঘবে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক জরুরীভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
এদিকে, সাতক্ষীরা সদরের মাছখোলা হাইস্কুল, মাছখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানিতে ডুবে আছে কয়েক মাস। এতদিন সমস্যা হয়নি। সম্প্রতি স্কুল খুলে দেওয়ার পর সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলে দোতলায় ক্লাস নেওয়া হচ্ছে বলে জানান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এদিকে জেলা সদরের বড়দল প্রাইমারি স্কুলের অবস্থাও একই। সেখানেও জমেছে পানি। পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিলনী মাদ্যমিক বিদ্যালয়, নলতা মোবারকনগর বাজার ও তৎসংলগ্ন এলাকা পানিতে ডুবে গেছে।
নলতা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো: আবদুল মোনায়েম বলেন, এক রাতের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে নলতা হাইস্কুল, কেবি আহসানিয়া জুনিয়র স্কুল, নলতা শরীফের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার ও রাস্তাঘাট। তিনি আরও বলেন, পানি নিষ্কাশনের পথ দখল করে মাছের ঘের করার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে পানিতে নিমজ্জিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কোন শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না। কবে নাগাদ সম্ভব হবে তাও অনিশ্চিত। শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার ভ্যানে চড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পানি পার হয়ে স্কুলের বারান্দায় পৌছায়। পানি পার হতে না পেরে অনেকেই বাড়ি ফিরে যায়। কালিগঞ্জ উপজেলার ভদ্রখালি প্রাইমারি স্কুলের মাঠে হাঁটু পানি। পানি ঢুকেছে শ্রেণিকক্ষে। ফলে সেখানেও ক্লাস করা অসম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আশাশুনির উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসীম চক্রবর্তী বলেন, প্রতাপনগর ফাজিল মাদ্রাসা, প্রতাপনগর ইউনাইটেড একাডেমি ও কল্যাণপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কুড়িকাহুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কুড়িকাহুনিয়া মহিলা মাদ্রাসা, প্রতাপনগর মহিলা মাদ্রাসা, কল্যাণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রতাপনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে গেছে।
এলাকার সাইদুল ইসলাম, মিলন বিশ্বাস, রুহুল আমিনসহ অনেকেই জানান, স্থানীয় প্রতাপনগর তালতলা জামে মসজিদ, কুড়িকাহুনিয়া পাঞ্জেগানা মসজিদ ও উপজেলাগামী প্রধান সড়ক এবং গড়ইমহল খালের কাঠালতলা রাস্তাটি পানিতে নিমজ্জিত। এতে করে কুড়িকাহুনিয়া, শ্রীপুর, দৃষ্টিনন্দন, গোয়ালকাটি, সনাতনকাটি, গোকুলনগর, নাকনাসহ সাত গ্রামের মানুষ নৌকায় যাতায়াত করছেন। এলাকার কবরস্থানগুলোর উপরে কোমর সমান পানি। এ ছাড়া গড়ইমহল খালের ধারের শ্মশানটিও বিলিন হয়ে গেছে। এতে করে এলাকার চার গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বী মৃত মানুষের দাহ করার কোন জায়গা নেই।
এদিকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদ চত্ত্বর, বিজিবি ক্যাম্প, ঋশিল্পী, বিসিক শিল্পনগরীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জলাবদ্ধতার কবলে পড়েছে। পানি থৈ থৈ করছে এসব সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে।
সাতক্ষীরা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম আব্দুল্লাহ আল মামুন মঙ্গলবার রাতে দৈনিক পত্রদূতকে বলেন, একদিনের ভারি বৃষ্টিতে জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস করানো সম্ভব হচ্ছে না। বিকল্প ব্যবস্থায় ক্লাস করা যায় কীনা সে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, জেলার শ্যামনগরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। কালিগঞ্জ, আশাশুনি, দেবহাটা, তালা ও কলারোয়ার নি¤œাঞ্চলের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ নেওয়া হয়েছে। কালিগঞ্জের কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠে গেছে। পানি নিষ্কাশন না হলে এসব প্রতিষ্ঠানে ক্লাস করা কঠিন। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, সদরের নুনগোলা মাদ্রাসা, মাছখোলা হাইস্কুল, নেহালপুর হাইস্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খোঁজ নেওয়া হয়েছে। শুধু হাইস্কুল নয়, মাদ্রাসা ও প্রাইমারি স্কুলও জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। সেখানেও শিক্ষা ব্যবস্থা চরম হুমকির মুখে।