আধুনিক যোগে রাবার মানুষের জীবনে এক অপরিহার্য উপাদান। শিশুদের দুধের ফিডার থেকে শুরু করে বিমানের চাকা তৈরী পযন্ত রাবারের ব্যবহার। অল্প খরচে অধিক লাভ জনক এই রাবার উৎপাদন সিলেট অঞ্চলে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু স্থানীয় ভাবে গড়ে উঠেছে না রাবার থেকে উৎপাদিত শিল্প কারখানা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে বানিজ্যিক ভাবে রাবার চাষের প্রথম পরিকল্পনা করেন তদানীস্থন পূর্ব বাংলার বন শিলেপর প্রধান কাজী গোলাম গাউস। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ড. সি কে রহিম প্রমান করেন এদেশের মাটি, আবহাওয়া রাবার চাষের জন্য অত্যন্ত অনুকূলে তাই এখানে লাভ জনক রাবার চাষ সম্ভব। তখন পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী প্রকল্পের আওতায় ৭১০ একর জমিতে রাবার চাষের একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ১৯৬০ সালের ১ লা জুলাই থেকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৬১ সালে এখানে চারটি রাবার বাগান প্রতিষ্টা করা হয়। এই গুলো হচ্ছে কক্সবাজার জেলার রামু, চট্টগ্রাম জেলার রাউজান ও হাটাজারী এবং মৌলভীবাজার জেলার নন্দরানী। তখন রাবার চাষে সহায়তা করার জন্য বিদেশ থেকে একজন বিশেষজ্ঞ আনা হয়। তার পরামর্শে রাবার চাষ ৭১০ একর থেকে বাড়িয়ে দেড় হাজার একর করা হয়। এই সময় রাবার প্রকল্পের দায়িত্ব বন বিভাগ থেকে বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের হাতে ন্যস্ত করা হয়। অবশ্য কয়েক বছর পর চা বাগান সম্প্রসারন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কারণে হাটাজারী ও নন্দরানী রাবার বাগান বন্ধ হয়ে যায়। তবে রাবার গাছের উত্তরসুরী হিসাবে এই বাগান গুলো এখনও পরিচিত।
বিভিন্ন সময়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর সহ বিশ্বের রাবার উৎপাদনকারী দেশের সংশি¬ষ্ট বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে উৎপাদিত রাবারের গুণগত মানের প্রশংসা করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাবার চাষের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি, ক্ষয়রোধ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। বাংলাদেশ মৌসুমী অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বলে এখানে রাবার চাষের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।
বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের (বশিউক) সিলেট জোনাল অফিস শ্রীমঙ্গল সূত্রে জানা যায়, সিলেট বিভাগের সরকারি ও বেসরকারিভাবে উৎপাদিত রাবার দেশের চাহিদার ৫৫ শতাংশ। বর্তমানে যেভাবে রাবার চাষের পরিধি বাড়ছে তাতে এক দশকের মধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশ রাবার উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে সংশি-ষ্টরা মনে করেন। বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের আওতায় মোট ১৫টি রাবার প¬ান্টেশনের মধ্যে সিলেট বিভাগে রয়েছে চারটি। এগুলো হচ্ছ্ েরুপাইছড়া, সাতগাঁও, ভাটেরা, শাহাজিবাজার। এ ছাড়া কোম্পানি ও বেসরকারি উদ্যোগে ছোট বড় ১৬৯টি রাবার প¬ান্টেশন রয়েছে। সরকারি রাবার প¬ান্টেশনের মধ্যে সব চেয়ে পুরনো রাবার প¬ান্টেশন হচ্ছে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রুপাইছড়া রাবার প¬ান্টেশন রুপাইছড়া পাহাড়ি এলাকায় ১৯৭৭ সালে সরকারিভাবে ৭৫ একর জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে রাবার চাষ করে সুফল পাওয়া যায়। বর্তমানে ২ হাজার ২৬২ একর ভূমির এই বাগানে গাছের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। দেশের সরকারি রাবার বাগানগুলোর মধ্যে উৎপাদনের দিকে প্রথম সারির বাগানের রাবার কষ বা লেটেক্স মানের দিক দিয়ে রুপাইছড়া ‘এ-ওয়ান’ পর্যায়ের। এই বাগানে প্রতিদিন গড়ে এগার হাজার কেজি রাবার কষ আহৃত হয়। দুই হাজার ৫০ একর ভূমির ওপর গড়ে ওঠা শাহজিবাজার রাবার বাগানে গাছের সংখ্যা আড়াই লক্ষাধিক। এ গাছগুলো থেকে প্রতিদিন ছয় হাজার কেজি কষ পাওয়া যায়। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে রাবার চাষের প্রসার অন্যান্য স্থানের চেয়ে বেশি। তবে চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, কুমিল্লা অঞ্চলের মাটি রাবার চাষের জন্য খুবই উপযোগী বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। সিলেট অঞ্চলের চা বাগানের পতিত জমিতে আশির দশক থেকে পরীক্ষামূলকভাবে রাবার চাষ শুরু করা হয়। রাবার চাষ লাভজনক হওয়ায় বর্তমানে দেশের ১৬৪টি চা বাগানের প্রায় ২০ হাজার একর পরিত্যক্ত ও পতিত জমিতে রাবার চাষ করা হচ্ছে। সরকারি, বেসরকারি ও চা বাগানের উদ্যোগে দেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫ হাজার একর জমিতে ও চা বাগান মিলে মোট ১৮৪ টি রাবার বাগান রয়েছে।
সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, দেশের বৃহৎ চা কোম্পানি জেমস ফিনলের সাতটি রাবার বাগানে প্রায় ৬ হাজার একর, ডানকান ব্রাদাসের ১৫টি বাগানে প্রায় ৫ হাজার একর, ন্যাশনাল টি কোম্পানির ১৩টি বাগানে প্রায় ৯০০ একর, চা বোর্ডের তিনটি বাগানে প্রায় ৪৫০ একর, দেউন্ডি টি কোমপানির চারটি বাগানে প্রায় ৬০ একর, প্রাইভেট কোমúানিভুক্ত ৫৭টি বাগানে প্রায় ৮ হাজার একর ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ৬০টি বাগানে প্রায় ৫হাজার একর জমিতে রাবার চাষ করা হচ্ছে। বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের ১৫টি রাবার বাগানের অর্ধেকেরও বেশি জমিতে রাবার চাষ করা হচ্ছে চা বাগান এলাকায়। চা চাষের উৎপাদন খরচের চেয়ে রাবার চাষে ৭৫ শতাংশ কম খরচ ও লাভজনক হওয়ায় রাবার চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে চা বাগান কর্তৃপক্ষ। যেসব চা বাগানে রাবার চাষ করা হচ্ছে, সেসব বাগান এলাকায় রাবার প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানাও রয়েছে। বর্তমানে রাবার চাষে পুরনো পদ্ধতি বাদ দিয়ে নতুন পদ্ধতিতে রাবার চাষ করে সময় সাশ্রয় করার পাশাপাশি মুনাফাও বেশি বলে জানা গেছে।
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের রাবার জাত-দ্রব্য উৎপাদনে বৃহৎ শিল্প কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব। বিশেষ করে যানবাহনের ট্রায়ার-টিউব উৎপাদনের বৃহৎ শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হলে বিদেশ থেকে চড়া দামে এইসব ট্রায়ার টিউব আমদানি হ্রাস পাবে। তাছাড়া অন্যান্য রাবার জাত সামগ্রী ও উৎপাদনের সকল সুযোগ এখানে বিদ্যমান রয়েছে।