কাশফুলের অপরূপ সৌন্দর্য বিমোহিত করে মানুষকে। কাশফুল নিয়ে কালে কালে কবি-সাহিত্যিকরা নানা রচনা করে আমাদের তৃপ্ত করেছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায়,‘কাশফুল মনে সাদা শিহরণ জাগায়, মন বলে কত সুন্দর প্রকৃতি, ¯্রষ্টার কী অপার সৃষ্টি।’ কবি জীবনানন্দ দাশ শরৎ বন্দনায় লিখেছেন,‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর’। কবি জসীম উদ্দীন ‘বিরহী নারী’ মননে কবিতায় লিখেছেন-‘গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস, বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস’। এমন শতশত উক্তি রয়েছে বাংলার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়া কাশফুল নিয়ে। কারো জন্য কাশফুল মনের মুগ্ধতা বাড়ায় আবার কারো জন্য অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বাড়ায়।
প্রকৃতিতে যখন শরৎকাল আসে তখন কাশফুলই জানিয়ে দেয় তার আগমনী বার্তা। এবারেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। কুড়িগ্রামের বিভিন্ন চরাঞ্চলে কাশফুলের রাজত্ব দেখে যে কারুরই চোখ-মন জুড়িয়ে যায়। স্থানীয় মানুষজন একে কাশিয়া বলে। কাশফুলের বাতাসে দোল খাওয়ার দৃশ্য যেন মন কাড়ে সবার। স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে মনপ্রাণ। প্রতিবছর শরতের এই সময়টাতে চরাঞ্চলে শহরের মানুষের পদাচারণ পড়ে। কাশফুলের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন প্রকৃতিপ্রেমীদের পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে চরাঞ্চল। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য আরও বাড়িয়েছে চরাঞ্চলের বড় বড় ঝাউ গাছগুলো। এসব ঝাউ গাছে লাল, গোলাপী, হলুদসহ বিভিন্ন রংয়ের ফুল ফোটায় বাড়তি আকর্ষণ বাড়িয়েছে অবহেলিত এসব এলাকায়।
শরতের শেষ বিকেল। থেমে থেমে বৃষ্টি। কালো মেঘের আবরণ ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে মিষ্টি রোদ। সাদা মেঘের মিটিমিটি হাসি যেন শুভ্রতা ছড়াচ্ছে চারদিকে। সাদা কাশফুল শারদ বন্দনার কলরবে মেতে উঠেছে। শরত শোভায় প্রকৃতিতে সাজ-সাজ রব। নীল আকাশে চলছে সাদা-কালো মেঘের লুকোচুরি। কখনো কালো মেঘে আবার কখনো সাদা মেঘের আররণে লুকিয়ে হাসছে সোনালী সূর্য-এভাবে ভাবতে কার না ভাল লাগে? পরন্ত বিকেলের এই মুহুর্তের দৃশ্য অন্য রকম। কেউবা স্ব-পরিবারে ঘুরতে আসেন আবার কেউ প্রিয়জনের সাথে আসেন সোনালী শরতের মিষ্টি গন্ধের স্বাদ নিতে।
কাশফুলের আদি নিবাস রোমানিয়ায়। কাশফুল মূলত ছন গোত্রীয় এক ধরণের ঘাস। ঘাস জাতীয় উদ্ভিদটি উচ্চতায় সাধারণত ৭-৮ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। গাছটির চিরল পাতার দুই পাশ বেশ ধারালো। কাশবন শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, এর রয়েছে নানা ঔষধি গুণও। নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের উঁচু স্থানে কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই কাশফুল বেশি জন্মাতে দেখা যায়। গ্রাম বাংলার অপরূপ শোভা কাশবন চিরচেনা দৃশ্য হলেও এই কাশবন এখন আগের মতো চোখে পড়ে না।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ার চর এলাকায় সাদা কাশফুলের সমারোহ দেখতে আসা কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থী আহসান রাফি বলেন, মন খারাপ থাকলে এখানে আসি। কিছুক্ষণ সময় কাটাই। মন ভালো হয়ে যায়। তবে নৌকা যোগে আসতে হয়। এজন্য সময় ও অর্থ দুটোই ব্যয় হয়।
একই কলেজের আরেক শিক্ষার্থী হেনা আক্তার বলেন, কাশফুল সত্যি প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। শহরে এমন দৃশ্য কল্পনাও করা যায় না। চরাঞ্চলে কাশফুল ছাড়াও এ সময় অন্যান্য ফুল ফোটে। আমাদের গ্রাম বাংলার অনেক ফুল হারিয়ে গেছে। তবে এখন নদী তীরবর্তী চরে কাশবন দেখে আসলেই মনটা ভালো হয়ে যায়।
পোড়ার চরের কাশেম আলী বলেন, চরের ভিতরা এই কাশিয়া অনেক কাজে লাগে। বন্যার সময় নদীর ¯্রােত কমায় বা ভাঙ্গন ঠেকায়। কাশিয়া গরুকে খাওয়ানো যায়। এছাড়াও পানের বরজের জন্য এই কাশিয়া রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল সহ দেশের অনেক জায়গায় নৌকা যোগে।
উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মোল্লারহাট এলাকায় নানা বয়সী লোকজনকে নৌকাযোগে কাশবাগানে ঘুরতে দেখা যায়। ঘুরতে আসা মমতাজ বেগম বলেন, আমার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ক’দিন পরপর আসি কাশফুল দেখতে। আমাদের এই স্নিগ্ধতা খুব ভাল লাগে। সাথে নৌকা ভ্রমণও হয়।
মোল্লারহাট চরের বাসিন্দা পাখি আক্তার বলেন, চরের মধ্যে কাশফুল আর ওলা (ঝাউ) গাছের বহু রংয়ের ফুল দেখতে অনেক মানুষ আসে। এই কাশ দিয়ে আমরা ঘরের বেড়া ও ছাউনি দেই এবং ঝাড়- বানাই। আর ওলা গাছ কেটে জ¦ালানির কাজে ব্যবহার করি। আবার সেগুলো বিক্রি করে বাড়তি আয় হয় যা সংসারের কাজে লাগানো হয়।
একই এলাকার মজিবর রহমান বলেন, চরের পরিত্যক্ত বালু জমিতে একাই হয় কাশিয়া। এর জন্য কোন টাকা- পয়সা খরচ করে আবাদ করা লাগে না। কাশিয়া ৭-৮ফুট লম্বা হয়। এর ফুল আড়াই থেকে ৩ফুট ফুল হয়। বছরে একবারই কাশিয়া হয়। কার্তিক মাসে এই কাশিয়া কাটা হয়। এক বিঘা জমিতে প্রায় পনের শ থেকে দু’ হাজার কাশিয়ার আটি হয়। কাশিয়া কেটে ১২/১৪ইঞ্চি করে আটি বেঁধে ১০/১২টাকা করে বিক্রি হয়। গড়ে প্রতি বিঘা জমি থেকে ১০ থেকে ১২হাজার টাকা আসে। কার্তিক মাসে চরে অভাব দেখা দেয়। কাশিয়া বিক্রি করে যে টাকা আসে তাতে কার্তিক মাসের অভাব পার হয়ে যায়।
এই বিষয়ে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মির্জা নাসির উদ্দিন বলেন, কাশফুল প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। শরতের এ সময় কাশবন দেখতে জেলার চরাঞ্চলগুলোতে মানুষের ভীড় জমে। কাশফুল শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়ায় না এর ঔষধি গুণও রয়েছে। মানুষের পিত্তথলিতে পাথর, শরীরে কোথাও ফোঁড়ার সৃষ্টি হলে তার ব্যথা উপশমে কাশের মূল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কাশ আমাদের পরিচিত উদ্ভিদ হলেও এর আদি নিবাস রোমানিয়ায়। এর ইংরেজি নাম ক্যাটকিন এবং বৈজ্ঞানিক নাম হলো স্যাকরারাম এসপোটেনিয়াম।