জামাল উদ্দিনের লাশ উদ্ধারের ৪৮ ঘন্টা পরই খুনীকে সনাক্ত করে গ্রেপ্তার করেছে সরাইল থানা পুলিশ। বেরিয়ে আসছে হত্যা কান্ডের মূল রহস্য। দ্বিতীয় বিয়েসহ তাদের পারিবারিক কলহ দীর্ঘদিনের। রয়েছে কথায় কথায় স্ত্রীকে তালাক দেয়ার হুমকির অভিযোগ। স্ত্রী হেলেনাও খুবই বদমেজাজি প্রকৃতির। এসবের জেরেই স্ত্রী হেলেনার দা-এর উপর্যুপরি কূপে গুরূতর আহত হন জামাল। রক্সক্ষরণ হয়ে দ্রƒততম সময়ের মধ্যেই তিনি মারা যান। তড়িঘড়ি করে বাড়ির পাশের কচুরিপানা ভরা ডুবায় লাশটি রেখে দেন স্ত্রী হেলেনা বেগম। ফাঁকে নিজেকে রক্ষার জন্য জিডিসহ নানা নাটক সাজিয়েছেন হেলেনা। হেলেনা স্বামীর পরিবারের সদস্যদের ফাঁসাতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেলেন। হত্যার ২ দিন পর গত সোমবার জামালের লাশটি উদ্ধার করেন পুলিশ। নিহত জামাল উপজেলার লোপাড়া গ্রামের হাজী আলী মিয়ার ছেলে। লাশ উদ্ধারের পর হত্যার কারণ ও খুনীকে চিহ্নিত করতে মাঠে নেমে পড়েন সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার মো. আনিছুর রহমান ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসলাম হোসেন। লাশ দাফনের একদিন পরই হত্যাকান্ডের ক্লো বের করে ফেলেন পুলিশ। খুলে যায় এ ঘটনার সকল জট। স্বামীকে হত্যার দায়ে নিজ কন্যাসন্তান সুরাইয়া খাতুনের (১৬) মামলার আসামি হয়ে এখন জেলহাজতে রয়েছেন মা হেলেনা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, তিন ভাইয়ের মধ্যে জামাল ছিলেন দ্বিতীয়। পেশায় ছিলেন দুগ্ধ খামারী। ১৯৮৯ খ্রিষ্টব্দে সামাজিক ভাবেই আপন মামাত বোন হেলেনাকে বিয়ে করেন জামাল। হেলেনা একই উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের দেওবাড়িয়া গ্রামের আরাফত আলীর মেয়ে। প্রথম দিকেই ভালই চলছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। ২ ছেলে ও ৫ কন্যাসন্তান জন্ম দেন তারা। ফাঁকে প্রথম স্ত্রী রেখেই চাচাত ভাই আলা উদ্দিনের স্ত্রী ৪ সন্তানের জননী বিধবা ফরিদা বেগমকে বিয়ে করেন জামাল। এই বিয়ের কোন নিকাহ নিবন্ধন হয়নি। শুধু মোল্লা দিয়ে বিয়ে পড়িয়েছিলেন। এতে ক্ষুদ্ধ হন হেলেনা। বিষয়টি কোন হেলোনা মেনে নিতে পারছিলেন না। ফরিদার গর্ভে আসে ১টি কন্যা সন্তান। কিছুদিন পরই ফরিদার সাথে জামালের দূরত্ব বেড়ে যায়। গত ২০ বছর ধরে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। সুযোগ গ্রহন করেছেন হেলেনা। জামালের বড় বোন রৌশনা খাতুনের মাধ্যমে সকলকে ম্যানেজ করে কাকুতি মিনতি করে জামালোর সাথে আবারও সংসার শুরূ করেন হেলেনা। কিন্তু হেলেনার ভেতরে প্রতিশোধের আগুন জ¦লছিল। বিষয়টি জামালের পরিবারের অনেক সদস্য আঁচ করতে পারলেও গুরূত্ব দেননি। জামালের ছোট ভাই মো. দ্বীন ইসলাম (৪০) বলেন, ‘‘হেলেনা ছিল অত্যন্ত দূর্ধর্ষ প্রকৃতির। কথায় কথায় ছটে যেত। যা ইচ্ছে তাই করত। হেলেনাকে প্রায়ই তার ছেলে মেয়ের কাছে বলতে শুনেছি ‘তোর বাবাকে (জামালকে) ঘুমে মাইরা ফালামু। লাশ গুম করূম।’’ গত ১৮ সেপ্টেম্বর শনিবার রাত থেকে নিখোঁজ হয় জামাল। সারা রাত স্বামীর স্বজনদের জানাননি হেলেনা। সকালে দেবর দ্বীন ইসলামকে জানান। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িসহ কোথাও মিলেনি জামালের সন্ধান। মুঠোফোনটিও বন্ধ। অবশেষে রোববারে হেলেনা বাদী হয়ে সরাইল থানায় একটি জিডি করেন। জিডি নম্বর-১০৩৩, তারিখ-১৯.০৯.২০২১ খ্রিষ্টাব্দ। ২০ সেপ্টেম্বর সোমবার খোঁজ খবর নিতে আসে হেলেনার ছোট ভাই মাহফুজ মিয়া (৩০) ও মেয়ের জামাতা। কুকুরে চিৎকার ও দূর্গন্ধে ঘর থেকে বের হয় তারা। হেলেনার বসতঘর থেকে মাত্র ২০-৩০ গজ দূরে একটি ডুবায় কচুরিপানার ফাঁকে মানুষের দুটি পা দেখতে পায়। পুলিশ এসে জামাল উদ্দিনের লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যান। হত্যার কারণ ও জড়িতদের সনাক্ত করার জন্য ঘটনাস্থলে ছুটে যান এ এসপি (সরাইল সার্কেল) মো. আনিছুর রহমান ও সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসলাম হোসেন। তারা দীর্ঘ সময় সেখানে কাজ করেন। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলের বিভিন্ন আলামত, স্বজনসহ প্রতিবেশীদের বক্তব্য, হেলেনা বেগমের কথার ধরণ চলাফেরায় পুলিশের সন্দেহ হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পুলিশ হেলেনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসেন। পুলিশের কাছে স্বামীকে হত্যা করার কথা স্বীকার করে হেলেনা। ৩১ বছরের সম্পর্ককে জবাই করেছে। গত বুধবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বামী হত্যার বিষয়ে স্বীকরোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে হেলেনা।
স্বামীকে যেভাবে হত্যা করে হেলেনা: বিভিন্ন কারণে দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ ছিল স্বামী জামাল উদ্দিনের উপর। তাই গত শনিবার রাতে ঠান্ডা মাথায় স্বামীকে নিজশয়ন কক্ষে খুন করেছে। রাতের খাবার শেষে বিছানায় যায় তারা। নিজে থেকেই বিভিন্ন অভিযোগের কথা বলে স্বামীকে ক্ষেপিয়ে তুলে। প্রথমে বাক-বিতন্ডা পরে হাতাহাতি। স্বামীকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় হেলেনা। এতে আহত হয় জামাল। এরপর বটি দা দিয়ে জামালের গলায় উপর্যুপুরি কূঁপাতে থাকে। রক্তাক্ত অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে দৌঁড়ে ভাইদের কাছে যেতে চেয়েছিল জামাল। কিন্তু পারেনি। কারণ রক্তক্ষরণের পরে তার দেহ অচেতন হতে থাকে। দৌঁড়ে বাড়ির পাশের ডুবার পাশে যায়। পেছন দিকে দৌঁড়ে যায় হেলেনাও। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা যায় জামাল। জামালের মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে তাকে ডুবায় পানির নিচে রেখে উপরে কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে দেয়।
ঘটনাস্থল সম্পর্কে যা বলেছে পুলিশ: অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় জামালকে খুন করেছে হেলেনা। বসত ঘরের মেঝেতে, বিছানায়, আলনার কাপড়সহ আশপাশের বেশ কিছু ব্যবহৃত জিনিষপত্রে রক্তের দাগ পাওয়া গেছে। হেলেনার পড়নের কাপড়েও ছিল রক্ত। খাটের নিচে পাওয়া গেছে হত্যার কাজে ব্যবহৃত ছুঁড়া ও বটি দা।
সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসলাম হোসেন বলেন, প্রথমে কোন ক্লো পাচ্ছিলাম না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিক নির্দেশনায় মাঠে কাজ করে এই হত্যাকান্ডের সবকিছু বের করতে সক্ষম হয়েছি। এটাই হচ্ছে পুলিশের কাজ। হেলেনা পরিকল্পিত ভাবে ঠান্ডা মাথায় নিজের স্বামীকে হত্যা করে পাশের ডুবায় ফেলে রেখে অনেক নাটক করেছেন। নিজের দেবর ভাসুরসহ টার্গেটের অনেককে হত্যা মামলা করে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে। এ ঘটনাটি হেলেনা একাই ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে নিশ্চিত হয়েছি। এরপরও তদন্ত চলছে।