বাসার ছাদে বাগান তৈরি নতুন কোনো ধারণা নয়। খ্রিস্টের জন্মের পূর্বেও ছাদবাগান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ব্যাবিলনের সেই ঝুলন্ত উদ্যানের কথা তো আমরা সবাই জানি। এ যুগে ছাদবাগানের প্রয়োজন আরো বেড়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের অস্তিত্ব না মিললেও ধারণা করা হয়, বিভিন্ন ছাঁদ ও বারান্দার সমন্বয়ে তৈরি ছিল সেটি। তবে ইতিহাসে ইরাকের মোসুল শহরের কাছেই আরেক ঝুলন্ত উদ্যানের নিদর্শন পাওয়া যায়।
ঢাকা একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহর। ঢাকামুখী মানুষের ¯্রােত প্রতিদিন বাড়ছে। নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। ফলে দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে শহরটি। থাকার জায়গা সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির ছাদের চিলেকোঠাও বসবাসের জায়গা হয়ে উঠেছে। বসতি বাড়ার সাথে সাথে মানুষের জন্য ঢাকার পরিবেশ দিন দিন প্রতিকূল হয়ে উঠছে। প্রচ- গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে নগরবাসীর জীবন। বৃদ্ধি পাচ্ছে তাপমাত্রা। শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ জায়গা দখল করে আছে ফাঁকা ছাদ, যা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বেশ সহায়ক। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করতে হলে গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। যেহেতু সমতলে গাছ লাগানোর জায়গা তেমন নেই, তাই বাসার ছাদে কিংবা ব্যালকনিতে বাগান করা হলে তাপমাত্রা অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি শহরের সব ছাদে পরিকল্পিতভাবে বাগান করা হয়, তাহলে তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমানো সম্ভব। ঢাকা শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, যা এই নগরীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অনেকাংশে দায়ী।
ঢাকায় মাটির অস্তিত্ব দিন দিন কমে আসছে। হারিয়ে যাচ্ছে খোলামেলা জায়গা। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে ছেয়ে গেছে শহর। ইট-কাঠের বদলে দ্রুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ইস্পাতের কাঠামো ও কাচে মোড়ানো বহুতল ভবন। কাচে মোড়ানো দরজা-জানালায় ও বাণিজ্যিক ভবনের টেকসই স্থাপনার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে হালকা, কিন্তু শক্তিশালী ধাতব পাত, ফাইবার ও গ্লাস। এতে তাপমাত্রা আরো বাড়ছে। কারণ, সূর্য থেকে তাপ ও আলো ধাতব ও কাচের কাঠামোর একটিতে পড়ে অপরটিতে প্রতিফলিত হয়। ঘন ঘন প্রতিফলনের কারণে কিছু নির্দিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা আশপাশের এলাকার তুলনায় সামান্য বেড়ে যায় এবং শহরজুড়ে তৈরি হয় অসংখ্য হিট আইল্যান্ড বা তাপ দ্বীপ।
প্রতিটি ভবনে ছাদবাগান হলে শহরের পরিবেশের ভারসাম্য অবস্থা ফিরে আসবে। শাকসবজি, ফলমূল, ফুলের বাগান, বনায়ন হলে পরিবারের সুষম খাদ্য যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি শাকসবজি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট হ্রাস পাবে। সঙ্গে বাজার ব্যবস্থায় অতিরিক্ত দামের স্থানে স্থিতিশীল দাম বিরাজ করবে। শহরের প্রতিটি ছাদে বাগান হলে তাদের নিজেদের চাহিদা অনেকাংশে নিজেরাই পূরণ করতে পারবে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে প্রচুর পরিমাণে সবজি রফতানি করে থাকে। শহরের প্রতিটি বাড়িওয়ালা একটু সময় করে ছাদবাগান করে নিজেদের উৎপাদিত সবজি দ্বারা নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে পারলে দেশে উৎপাদিত বাকি শাকসবজি, ফলমূল বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। পাশাপাশি বিশ্বায়নের এ যুগে অতি সহজে ই-কৃষির আওতায় শহরের প্রতিটি শিক্ষিত পরিবার এটা করতে পারে। নিজেদের উৎপাদিত এসব স্বাস্থ্যকর সবজি, ফলমূল গ্রহণ করলে মানুষের দেহের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এতে ফরমালিনযুক্ত বিষক্রিয়া থেকে শহরের মানুষ মুক্ত থাকবে। শহরের অনেক মানুষ আজ এই ছাদবাগানে এগিয়ে আসছে। তারা এখানে চাষ করছে শাকসবজি যেমন- পুঁইশাক, লাউশাক, মরিচ, ঢেঁড়স, টমেটো, পটোল, চিচিঙ্গা, মাশরুম ও শসা ইত্যাদি। আর ফল হিসেবে আম, কাঁঠাল, লিচু, কমলা, বরই, জলপাই, স্ট্রবেরি ইত্যাদি উৎপাদন করে থাকে।
এছাড়া এসব ভবনের ছাদে কিংবা এর কাঠামোতে বাগান করা গেলে বাগানের গাছ এ তাপ শুষে নেয় এবং গাছের দেহ থেকে যে পানি জলীয়বাষ্প আকারে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যায়, তা সেই স্থানের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে আনে। অসংখ্য ছাদবাগান বা শহুরে গাছপালা এ প্রক্রিয়ায় শহরের উচ্চ তাপমাত্রাকে কমিয়ে আনে।
শহরে প্রাণ ফেরাতে ছাদবাগানের বিকল্প নেই। শহরাঞ্চলে বাসযোগ্য পরিবেশ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা গড়ে তুলতে মানুষের মধ্যে সচেতন বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। টেলিভিশন, এফএম রেডিও থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে শহরের প্রতিটি বাড়িতে ছাদবাগানের গুরুত্ব ও লাভ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।