বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে প্রতিযোগিতার বিশ্ব। বিশ্বব্যাপী এখন চলছে তুমুল বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাত র্পযন্ত পণ্য পৌঁছাতে চলছে প্রতিযোগিতা। প্রতিটি পণ্যের আছে চটকদারি প্রচারণায় নিজস্ব মোড়কের চাকচিক্য। আছে বিক্রয় প্রতিনিধিদের বিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা। লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে তাঁরা বঞ্চিত হন কোম্পানির বরাদ্ধকৃত সুবিধা থেকে। জীবন আর জীবিকার তাগিদেই আমরা সবাই নানা পেশা বা ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে একটু স্বচ্ছলতার মধ্যে সংসারের চাকা ঘুরাতে চেষ্টা করছি। খাদ্য প্রস্ততকারী বা সরবরাহকারী ও বাজারজাতকারী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও একই প্রয়াস চালাচ্ছে। পুঁজি আর শারীরিক পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনই তাদের উদ্দেশ্য।
পুঁজির নিশ্চয়তা বিধানে তারা ন্যায়-নীতির কোন তোয়াক্কা করেন না। ভোক্তার মনোরঞ্জন, মোড়কের চাকচিক্যে, মেসানো হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য। কেননা তাঁরা জানেন টাটকা পণ্যের আকর্ষণ ধরে রেখে সংরক্ষণ ক্ষমতা বাড়ালে ভোক্তার মনোরঞ্জন সহজ এবং অধিক মুনাফাও সম্ভব। আর এই কাজ করতে গিয়ে শাকসবজি ও ফলমূলে তাঁরা প্রয়োগ করছেন ফরমালিন। তাদের এই অসাধু কর্মকা-ে সুষম খাদ্যগুলো বিষময় খাদ্যে পরিণত হচ্ছে।
সারা দেশ নকল পণ্যে ভরে গেছে। সাবান, শ্যাম্পু, লোশন, সুগন্ধি, লিপস্টিক, নেইলপলিশ, আইলাইনার, ফেসওয়াশ, বডিওয়াশহ সব ধরনের প্রসাধনী সস্তা দামে পাওয়া যায়। ইউরোপ, আমেরিকার নামিদামি কোম্পানি থেকে শুরু করে ভারতীয় এমনকি দেশীয় কোম্পানির ‘চালু’ পণ্যও নকলকারিরা নকল করে বাজারজাত করছে। লিপস্টিক, নেইলপলিশ, বডি স্প্রে, কিছু ধরনের শ্যাম্পু ও লোশনের কৌটাগুলো কিনে আনা হচ্ছে চীন থেকে। আবার দেশের ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও কেউ ভালো কৌটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব কৌটায় দেশীয় ছাপাখানা থেকে ছাপিয়ে নেওয়া স্টিকার, হলোগ্রাম, বারকোড ইত্যাদি বসিয়ে একেবারেই আসলের মতো করে তোলা হচ্ছে। কোনো কোনো পণ্যে বসানো হয় আমদানিকারকের স্টিকারও, যাতে পণ্যটি আমদানি করে আনা হয়েছে বলে ক্রেতার বিশ্বাস অর্জন করা যায়।
আমরা জানি, ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল তারিখে জনগনের বহুল প্রত্যাশিত ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ প্রণীত হয়। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ও আটটি বিভাগীয় শহরে ৭৪টি নিরাপদ খাদ্য আদালত রয়েছে। সম্প্রতি নিরাপদ খাদ্য আইন মেনে চলার জন্য মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে দেখা গেলেও ২০০৯ সালের ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে যথেষ্ঠ সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি জনস্বাস্থ্যা সংক্রান্ত এমনই এক বিষয় যে, এ ক্ষেত্রে কাউকে নূন্যতম ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। একথাও ঠিক যে, দেশে উৎপাদিত এবং আমদানিকৃত খাদ্য, পণ্যসামগ্রী ও কাঁচামালের গুণগত মান, ওজনমান, নিয়ন্ত্রনকারী বিএসটিআই-এর পরীক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে চলছে কিনা তা জানতে হবে। খাবার পানি, ভোজ্য তেল, তরল খাদ্যসহ মানুষের জীবনের সাথে জড়িত প্রায় দেড়শ’ পণ্যের ওজন ও গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির ওপর ন্যস্ত। প্রতিষ্ঠানটি প্রায়ই জনবলের অভাব এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরঞ্জামের অভাব দেখিয়ে দায় সারতে চায়।
খাদ্যে ও বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল মিশিয়ে এ দেশের বিশাল মানব সম্পদকে মানসিক ও দৈহিকভাবে নষ্ট করার যে হীন প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, তা নির্মূল করতে হবে। রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের আয়োজনে সীমাবদ্ধতা থাকবেই। তবে আন্তরিকতা, চেষ্টা-প্রচেষ্টা সর্বোপরি দেশ ও জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও জবাবদিহির তো কমতি থাকার কথা নয়। দেশের জনগণকে মানসম্পন্ন পণদ্রব্য পাবার ক্ষেত্রে সরকারেরর সুপ্রচেষ্টা থাকা জরুরী।
ক্রেতাকে ওজনে কম, খাদ্যে ভেজাল, জীবন রক্ষাকারী ঔষধে ভেজাল, নকল কারখানা, দুই নম্বরকে এক নম্বর বলে চালানো বা এক নম্বরের সাথে দুই নম্বর মেশানো এখন রেওয়াজ পরিণত হয়েছে। চারিদিকে ভেজাল আর ভেজাল, যেন ভেজাল পণ্যের গুণাগুণ ও মান শিল্পোন্নয়ন, বাণিজ্য উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। ভোক্তা বা ক্রেতাদের গ্রহণযোগ্য যথোপযুক্ত পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহকরণ নিশ্চিত করতে না পারলে অভ্যন্তরীন কিংবা বহির্বাণিজ্য কোনটিতেই আমরা সাফল্য অর্জন করতে পারবো না। পণ্যের গুণাগুণ, টেকসই ক্ষমতা, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যথোপযুক্ততা নিশ্চিত করতে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।