বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতসহ বিদেশি চ্যানেলগুলো এখন থেকে তাদের মূল কনটেন্ট বা অনুষ্ঠানের সাথে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারবে না। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলসহ বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে।
ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেল বিশেষ করে কলকাতাভিত্তিক বাংলা চ্যানেলগুলোর সিরিয়ালসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান, যেগুলো আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থী এবং পরিবার ও সমাজে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, সেসব বন্ধের দাবী দীর্ঘদিনের। এসব চ্যানেলের সিরিয়ালগুলোর গল্পে পারিবারিক ও সামাজিক ইতিবাচক দিকের চেয়ে নেতিবাচক দিকগুলো বেশি তুলে ধরা হয়। পারিবারিক কোন্দল, কূটচাল, পরকীয়া, অনৈতিক সম্পর্ক, লোভ-লালসা, নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রই সিয়ালগুলোতে বেশি প্রাধান্য পায়। এসব একশ্রেণির দর্শককে বেশি আকর্ষণ করে এবং এর দূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া মানুষের উপর পড়ছে। এমনকি হিন্দি ও বাংলা অপরাধবিষয়ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে বেশ কিছু খুনের ঘটনা ঘটেছে, যা অপরাধীরা স্বীকার করেছে। কলকাতার বাংলা সিরিয়ালে পরকীয়া, অনৈতিক সম্পর্ক ও কূটচালের গল্প দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। সিরিয়ালে অভিনেত্রীর পোশাকের অনুকরণে ঈদের সময় পোশাক কিনে না দেয়ার কারণে কিশোরীর আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে।
অধিকাংশ সিরিয়ালের নেতিবাচক গল্পের অনুকরণ আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে হতে দেখা যায়। অথচ সত্তরের দশকের শেষে এবং আশি ও নব্বই দশকে আমাদের দেশের একমাত্র চ্যানেল বিটিভি দেখার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মুখিয়ে থাকত। সকাল সন্ধ্যা, ভঙনের শব্দ শুনি, শুকতারা, সংশপ্তক, কোথাও কেউ নেই, এইসব দিনরাত্রির মতো অসম্ভব জনপ্রিয় নাটক উপভোগ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সীমান্তের কাছাকাছি এন্টেনা লাগিয়ে বিটিভি দেখত। আমাদের এসব ধারাবাহিকের কাহিনি যেমন ছিল ইতিবাচক ও জীবনঘনিষ্ট, তেমনি ছিল বিনোদন ও শিক্ষার মাধ্যম। এসব ধারাবাহিকে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় রীতিনীতি ও সংস্কৃতি অসাধারণভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। তার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের দর্শকের ওপর পড়ে এবং তারা আকৃষ্ট হয়। তবে স্যাটেলাইট বা আকাশ সংস্কৃতির ব্যাপক সম্প্রসারণের কারণে ভারতীয় ও বিদেশি চ্যানেলের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমাদের দেশেও সরকারি চ্যানেল বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডের বাইরে প্রায় ৩৫টির মতো বেসরকারি চ্যানেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব চ্যানেলের মধ্যে সংবাদভিত্তিক, সঙ্গীত, খেলাধুলা, শিশুতোষ এবং মিশ্র অনুষ্ঠানের চ্যানেল রয়েছে। তবে এসব চ্যানেল শুরুর দিকে দর্শক আকৃষ্ট করতে পারলেও অনুষ্ঠানের মানের কারণে তা ক্রমাবনতির দিকে ধাবিত। আকাশ সংস্কৃতির উন্মুক্ততার কারণে কলকাতাভিত্তিক বাংলা চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার শুরু হলে এবং তাদের নাটকের গল্পের টানাপড়েন ও নেতিবাচক দিকগুলো অল্প সময়ে আমাদের দর্শককে আকৃষ্ট করে। এ নিয়ে সুশীল সমাজের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হয় এবং তারা এসব চ্যানেল বন্ধ করার দাবী জানায়।
আমাদের পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর ভারতীয় ও বিদেশি চ্যানেল বন্ধের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। তবে এ ক্ষেত্রে যেসব চ্যানেলের মাধ্যমে অজানাকে জানা ও শেখার বিষয় রয়েছে, যেমন জিওগ্রাফি, ডিসকভারি, অ্যানিমেল প্লানেটÑএগুলো চালু রাখা দরকার। অন্যদিকে, অনুষ্ঠানের মান উন্নয়নের মাধ্যমে দর্শক আকৃষ্ট করার সুযোগ আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলোর সামনে এসেছে। এ সুযোগ চ্যানেলগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতীয় চ্যানেলগুলোর একটি-দুটি সিরিয়াল এবং রিয়েলিটি শো-ই দর্শক মাতিয়ে রেখেছে। আমাদের দেশের চ্যানেল কর্তৃপক্ষেরও উচিত আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে দর্শক আকৃষ্ট করে এমন অনুষ্ঠান নির্মাণ করা। এখন এ ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণ করা অসম্ভব কিছু নয়। কারণ, আমাদের দেশের যেসব মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠান ভারতীয় ও বিদেশি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিত, তারা এখন দেশীয় চ্যানেলে ভালো মানের অনুষ্ঠান নির্মাণে বিজ্ঞাপন ও বাজেট দিয়ে সহযোগিতা করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ফলে চ্যানেল কর্তৃপক্ষকে এ সুবিধা কাজে লাগিয়ে দর্শক আকৃষ্ট করার মতো অনুষ্ঠান নির্মাণে উদ্যোগী হতে হবে। দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতি, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে উন্নত মানের অনুষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে বিভিন্ন চ্যানেলে একাধিক তুর্কি সিরিয়াল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এসব সিরিয়ালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং শালীন পারিবারিক গল্প দর্শকের কাছে নির্মল বিনোদনের উৎস হয়ে উঠেছে। আমাদের নির্মাতারাও দেশীয় প্রেক্ষাপটে যুথবদ্ধ গল্প ও কনটেন্ট নিয়ে অনুষ্ঠান নির্মাণ করার সক্ষমতা রাখেন। এজন্য চ্যানেলগুলোর কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হতে হবে। সরকারকেও এ ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা ও অনুদান প্রদানের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে।