দক্ষিণ এশিয়ার ছোট একটি দেশ বাংলাদেশ। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটিতে আছে ২২ প্রজাতির উভচর, ১০৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ ও ১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সরীসৃপ, ৩৮৮ প্রজাতির আবাসিক, ২৪০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এবং ১১০ প্রজাতির আন্তর্দেশীয় ও ৩ প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। এমন ছোট একটি দেশে বন্যপ্রাণীর এরূপ বিপুল সমাবেশ এবং বৈচিত্র্য এক আশ্চর্য ঘটনা, যেখানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল, ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের বনাঞ্চল এবং মনোরম জলবায়ু বহু যুগ ধরে বাংলাদেশকে বিচিত্র বন্যপ্রাণীর অনবদ্য আবাস হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বর্তমানে দেশের আন্তর্দেশীয় ও আবাসিক ৮৯৫ প্রজাতির মধ্যে ২০১ প্রজাতি বিভিন্ন ধরনের হুমকির সম্মুখীন এবং ২২৩ প্রজাতির অবস্থা অনিশ্চিত ও আশঙ্কাজনক।
বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক দুর্লভ বন্যপ্রাণী। গত ১০০ বছরে হারিয়ে গেছে এক ডজনের বেশি বন্যপ্রাণী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এক শিংবিশিষ্ট গন্ডার, জাভান গন্ডার, এশিয়ান দু’শিংবিশিষ্ট গন্ডার, গাউর, বেন্টিং, বুনো মহিষ, হরিণ, নীলগাই, নেকড়ে, নুকতা হাঁস, ময়ূর এবং বাদার কুমির। যেহেতু অধিকাংশ বন্যপ্রাণী প্রধানত বনাঞ্চলের ধরন, অবস্থা এবং বিস্তৃতির উপর নির্ভরশীল, এসব প্রাকৃতিক পরিবেশের অবনতি তাই স্থানীয় ও আবাসিক পশুপাখিকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে বনাঞ্চলের অবনতি ঘটেছে প্রচন্ডভাবে। অনুমান করা হয় যে, ১৯৭০ দশক থেকে বনভূমির পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগের বেশি হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯০ সালের এক হিসাব থেকে জানা যায় বাংলাদেশে মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ ০.০২ হেক্টরের কম। নিঃসন্দেহে বনভূমি ও মানুষের মধ্যকার এ অনুপাত পৃথিবীর যেকোন দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। বর্তমানে দেশে বন আচ্ছাদনের পরিমাণ ৮% এর কম।
১৯২৭ সালের ভারতীয় বন-বিধিতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা ছিল না। এতে অবশ্য বনসম্পদের সংজ্ঞা দিতে সব বন্যপ্রাণী এবং চামড়া, দাঁত, শিং, হাড়, রেশম, গুঁটি, মধু, মোম ইত্যাদির উল্লেখ ছিল। ব্রিটিশ আমলে প্রয়োজনবোধে বন্য পাখি ও অন্যান্য প্রাণী অথবা কোন নির্দিষ্ট প্রজাতি সংরক্ষণের জন্য কয়েকটি বিশেষ আইন চালু ছিল। এগুলি হলো: ১. বন্য হাতি সংরক্ষণ আইন, ১৮৭৯; ২. বন্য পাখি ও জন্তু সংরক্ষণ আইন, ১৯১২; এবং ৩. বন্য গন্ডার সংরক্ষণ আইন, ১৯৩২।
এসব আইন ছাড়াও ভারতীয় বন-আইন, ১৯২৭ ও অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ সরকারের নিকট বনে শিকার ও মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে, যা প্রয়োজনবোধে প্রযোজ্য। পরবর্তীকালে ১৯৫৯ সালে সরকার ব্যক্তিগত ও সরকারি বনে এসব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য পৃথক দুই প্রস্থ আইন তৈরি করে। এ দুটি বিধি মোতাবেক বন নিম্নোক্তভাবে শ্রেণিবদ্ধ হয়েছে। যথা: প্রথম শ্রেণি: কোন বিশেষ প্রজাতির অবলুপ্তি রোধের জন্য কিংবা অভয়ারণ্য বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে এসব বনে সব ধরনের শিকার, ফাঁদ-পাতা বা মাছ-ধরা নিষিদ্ধ, যতদিন না একটি প্রজাতি বৃদ্ধি পেয়ে অন্যান্য সম্পদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় শ্রেণি: এই ধরনের বনে এসব আইন মোতাবেক বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বা অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাই শুধু শিকার, ফাঁদ-পাতা বা মাছ ধরতে পারবে।
এসব আইন বন্যপ্রাণী রক্ষায় ততটা কার্যকর বলে প্রমাণিত হয় নি। ফলে, বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৩, ১৯৭৩ হিসাবে ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আদেশ ১৯৭৩’ জারি করে। অতঃপর ‘বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) বিধি, ১৯৭৪’ হিসেবে ১৯৭৩ সালের এই আইন সংশোধিত, সম্প্রসারিত ও পুনঃবিধিবদ্ধ হয়। সংশোধিত বিধিতে আছে ৪৮ ধারা ও ৩ তফশিল। এতে রয়েছে: বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা পরিষদ গঠন, অভয়ারণ্য, জাতীয় পার্ক ও শিকারভূমি প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা; আইনভঙ্গকারীর জন্য জরিমানা ও শাস্তি; বন্যপ্রাণী আমদানি ও রপ্তানি; ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন; সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, এবং এই আইনের ভিত্তিতে বিধি-বিধান প্রণয়ন।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের আইন থাকলেও আইনের কঠোর প্রয়োগ নেই। ফলে বন্যপ্রাণী নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে। এতে ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রকৃতি। আমাদের নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যই বন্যপ্রাণীকে রক্ষা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর ভূমিকা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। নতুন প্রজন্মকে বন্যপ্রাণী ও পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে কাজটা খুব সহজ হবে আর ভবিষ্যৎ পৃথিবী হবে নিরাপদ। সে জন্য প্রয়োজন প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত কারিকুলাম তৈরি করা।