শিক্ষা মানুষকে সুনীতির পথে ধাবিত করে। অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসার পথ দেখায়। দুর্নীতির অবস্থান সুনীতির বিপরীতে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো ধরনের দুর্নীতিই বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, আমাদের এ দেশে শিক্ষা ও দুর্নীতি বহু ক্ষেত্রে একাকার হয়ে পড়েছে। শিক্ষা খাতের এমন দিক নেই যেখানে দুর্নীতির নোংরা শকুন থাবা বিস্তার করেনি। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনিয়ম আর দুর্নীতি যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে শিক্ষা খাতের সার্বিক যে চিত্র উঠে এসেছে, তা এককথায় ভয়াবহ। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাÑসর্বত্র দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থা জেঁকে বসেছে।
টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমপিওভুক্তি, নিয়োগ, বদলি, পাঠদানের অনুমতিসহ বিভিন্ন কাজে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত টাকা অর্থাৎ ঘুষ দিতে হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও এর অধীন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্তির (মাসে বেতন বাবদ সরকারি টাকা) কাজে চার স্থানে ‘হাদিয়া বা সম্মানী’ দিতে হয়। এ কাজে পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূত দিতে হয়।
এমপিওভুক্তি এখন অনলাইনে হয়। কিন্তু সেটা নামে মাত্র। পুরোপুরি এটা ডিজিটাল করা হয়নি। সফটওয়্যার ঠিকমত কাজ করে না। ফলে ম্যানুয়ালি কাজ করা হয়। সফটওয়্যার ঠিক থাকলে দুর্নীতি অনেকটা কমত। আগে পুরোপুরি কাগজে হত। তার চেয়ে এখন দুর্নীতি কমছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার গুণগত মানের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই কাজ হচ্ছে না। দুর্নীতি শিক্ষার মান কমিয়ে দিচ্ছে। এখন এমপিও শিক্ষকদের সুযাগ সুবিধা আগের চেয়ে বাড়ানো হলেও মান কমছে।
২০১০ সালে ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষা প্রশাসনে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছিল। যুগের চাহিদা মেটাতে পারে এমন শিক্ষাক্রম চালু ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য যে আইন দরকার, গত বছর থেকে তা খসড়া পর্যায়ে আছে। নোট বই, গাইড বই থাকবে কি থাকবে না, কোচিং সেন্টার চলবে কি চলবে না, সেই বিতর্কেই সময় চলে গেল। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী পদে পরিবর্তন এল। ২০২২ সাল থেকে পাঠক্রম পরিবর্তনের পরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাকাঠামোয় কোনো পরিবর্তন আসেনি। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হলেও অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে আগের নিয়মেই, যেখানে ঘুষ ও রাজনৈতিক প্রভাব দুটোই সক্রিয়। জাতীয় শিক্ষানীতিতে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছিল, তা-ও অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি।
টিআইবির প্রতিবেদনে কেবল শিক্ষা বিভাগের দোষ খোঁজা হয়নি, সমস্যা সমাধানের ২০ দফা সুপারিশও করা হয়েছে। সরকার এই সুপারিশকে ভিত্তি ধরেও কাঠামোগত সংস্কারের কাজটি করতে পারে। সর্বশেষ শিক্ষা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দের কথাও বলতে হয়। টাকার অঙ্কে যা-ই হোক না কেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দের হার কম। আশা করি, এদিকেও নীতিনির্ধারকেরা দৃষ্টি দেবেন। এ ছাড়া যথোপযুক্ত তদন্তের মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে তার তালিকা প্রকাশ করতে হবে, এবং দুর্নীতির সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ম্যানেজিং কমিটির নিয়মে পরির্তন এনে এমপি নয়, শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন। এমপি হলেই শিক্ষা বুঝবেন এমন কোনো কথা নেই। আর সদস্যরা তেমন লেখাপড়া জানেন না। শিক্ষার জন্য তাদের দরদ থাকে না। তাদের থাকে অন্য আগ্রহ। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসকারী শকুনদেরকে সরকার শক্তহাতে দমন করবে এটাই সকলের প্রত্যাশা।