কৃষক চায় ন্যায্য মূল্য, ভোক্তা চায় কম মূল্য আর ব্যবসায়ী চায় বেশী মূল্য। এ তিন মূল্য সমন্বয় করে সকলকে সন্তুষ্ট করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় কৃষকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁরা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য খুব কমই পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পায়। যেমন, এবার পাটের দাম ভালোই পেয়েছে। উৎপাদন খরচ উঠিয়েও বেশ লাভ করেছে। প্রায় প্রতিবছরই দেখা যায়, উৎপাদিত অনেক ফসলের উৎপাদন খরচ পর্যন্ত কৃষক পায় না। এমনকি কোনো কোনো ফসলের মাঠ থেকে তোলার কিংবা বাজারে নেয়ার খরচও ওঠে না। এরকম পন্ডশ্রম ও লোকসান কৃষকদের হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে। কখনো কখনো এর জের হিসেবে তারা ফসল ফেলে দেয়, গবাদী পশুকে খাইয়ে দেয় কিংবা পুড়িয়ে ফেলে। পাট ও আখের ক্ষেত পোড়ানোর কথা কিংবা মূলা-বেগুন-টমাটো ফেলে দেয়ার কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
এটা বলাই বাহুল্য, কৃষক যখন কোনো ফসলের ন্যায়সঙ্গত মূল্য পায় না, তখন সেই ফসলের আবাদ-উৎপাদন পরবর্তীতে কমিয়ে দেয়। পাট ও আখের উৎপাদন কমে যাওয়ার এটাই মূল কারণ বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। চলতি মৌসুমে আলু নিয়ে কৃষক, মজুদকারীরা ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কায় রয়েছে। জানা যায়, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৯০ লাখ টন। এবার উৎপাদিত হয় ১ কোটি ১০ লাখ টন। এই হিসাবে আলু উদ্বৃত্ত রয়েছে ২০ লাখ টন। মোট উৎপাদিত আলু থেকে দেশের ৪০০ কোল্ড স্টোরেজে ৪০ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হয়। এই আলুর অধিকাংশই বিক্রী হয়নি। উৎপাদন ও স্টোরেজের খরচ প্রতিকেজিতে ১৮ টাকা পড়লেও কৃষক ও মজুদদাতরা পাচ্ছে ৯ টাকা। এই বিরাট ক্ষতির কারণে কোল্ড স্টোরেজ থেকে অনেকেই আলু তুলছে না। আগামী তিন মাসের মধ্যে অন্তত ২০ লাখ টন আলু বিক্রী নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে আলুর মালিকেরা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, কমপক্ষে ১০ লাখ টন আলু অবিক্রীত থেকে যেতে পারে। দু’মাস পরেই আলুর নতুন মৌসুম শুরু হবে। তখন নতুন আলু কোল্ড স্টোরেজে রাখা নিয়েও সমস্যা দেখা দেবে।
বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থায় একটি পণ্য উৎপাদিত হওয়ার পর কৃষক থেকে ফড়িয়া বা বেপারী বা পাইকারী ব্যবসায়ী সরাসরি ক্রয় করে থাকেন। ফড়িয়া বা বেপারী বা পাইকার এদেরকে মধ্যসত্বভোগী ব্যবসায়ীও বলা হয়ে থাকে। তারা ক্রয়কৃত পণ্যটি সরাসরি আড়তদারের নিকট বিক্রি করে থাকেন। আড়তদার লাভের উপর নির্দিষ্ট কমিশনে খুচরা বা পাইকারী ব্যবসায়ীদের নিকট পণ্য বিক্রয় করে থাকেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা সরাসরি কৃষক বা ফড়িয়া, বেপারী ও পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও পণ্য কিনে থাকেন। কৃষক ছাড়া বাকী সব ব্যবসায়ীদের মাঝে একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সেটাকে যোগসাজস বা সিন্ডিকেট বলা হয়। মূলত খুচরা বাজারে দাম ব্ৃিদ্ধর অন্যতম কারণ হলো এই সিন্ডিকেট। আমাদের দেশের বেশীরভাগ কৃষক প্রান্তিক ও ছোট। ফসল উৎপাদনের জন্য তাদের নগদ টাকার প্রায় অভাব থাকে। ফলে বেশীর ভাগ কৃষক সুদে মহাজন থেকে ধার কর্জ করে ফসল ফলায়। কৃষকদের সংগঠন না থাকার কারণে বিছিন্নভাবে পণ্য বিক্রি করে থাকেন। ফলে দরকষাকষির ক্ষমতা হারায়। অনেক জায়গায় সংগঠন থাকলেও সেটা দূর্বল প্রকৃতির। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা সংখ্যায় কম থাকলেও নিজেদের মধ্যে বুঝাপড়া থাকে। আর এ বুঝাপড়ার কারণে কৃষক তার চাহিদা মতো দাম হাকাতে পারে না। বেশীরভাগ কৃষি পণ্য যেহেতু পচনশীল তাই এটা বেশীদিন ধরে রাখাও যায় না। আবার ধরে রাখার মতো সংরক্ষনাগারের খুব অভাব। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি করে অথবা আগাম পণ্য বিক্রি করে দেয়। ফলে ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়।
কৃষকদের ফসল ও উৎপন্নদ্রব্যের ন্যায্যমূল্য যাতে নিশ্চিত হয়, সরকারকে তার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। আলু চাষিদের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখী যাতে তাদের না হতে হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। পচনশীল ও সংরক্ষণযোগ্য পণ্যের সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। সুষ্ঠু ও আধুনিক বাজারব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য দূর করতে হবে এবং তদারকি বাড়াতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষায়, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। সুতরাং কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেÑএটাই প্রত্যাশা।