সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে, বাছবিচার ছাড়া সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা নতুন নয়। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে রংপুরের পীরগঞ্জে এমন হামলার ঘটনা আবার ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর মাঝিপাড়া এলাকায় ২৫ পরিবারের ঘরবাড়িতে অগ্নিকান্ডসহ গ্রামের বেশকিছু সংখ্যালঘু পরিবারের ঘরবাড়ি ভংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। এ ঘটনার ৪২ জন আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ। রোববার রাতে অকস্মাৎ এই ঘটনা ঘটে।
রংপুর জেলার সহকারী পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান জানান, স্থানীয় সংখ্যালঘু পরিবারের এক কিশোরের বিরুদ্ধে ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগের পর এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ তার বাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলেও দূওে মাঝিপাড়া এলাকায় বাড়িঘরে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তবে এখন পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
মন্দিরে হামলা, ভাঙচুরসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাটের ঘটনায় সরকার রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেÑআওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে এমন আলোচনা আছে। তবে বরাবরের মতোই এসব ঘটনায় দেশি-বিদেশি ‘ষড়যন্ত্র’ রয়েছে বলে মনে করছেন নেতারা। পাশাপাশি এ ধরনের হামলার বিষয়ে আগাম তথ্য না থাকায় গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টি নিয়েও দলের নেতারা ব্যক্তিগত এবং অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে আলোচনা করছেন।
সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের হাত দেখছেন নেতারা। একই সঙ্গে তাঁরা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা আরও হতে পারে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, এবারের পূজাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হতে পারেÑএটা আগে থেকে আঁচ করতে না পারার বিষয়টি গোয়েন্দা ব্যর্থতা। এর দায় সরকার এড়াতে পারবে না। এখন মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ক্ষতি কমানো (ড্যামেজ কন্ট্রোল)। মন্দিরে হামলার ঘটনায় ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়াও সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের ভাবাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের ঘটনার বিষয়ে ভূমিকা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। বিষয়টি আন্তর্জাতিক রূপ পেলে সরকার ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে বলে মনে করছেন নেতারা।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুটি কাজকে খুব জরুরি বলে তাঁরা মনে করছেন। প্রথমত, আওয়ামী লীগ ও সরকারকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে থাকতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে। পাশাপাশি হামলাকারীদের শাস্তির আওতায় এনে সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রচার করে সরকারের রাজনৈতিক ক্ষতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একজন নেতা জানান, ভারত বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে এমন চেষ্টা আরও বেড়েছে, যা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে
নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ নিজেদের রাজনৈতিক দুর্বলতার বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে। পূজা উপলক্ষে দলের নেতা-কর্মীদের আগে থেকেই তৎপর থাকার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া ছিল। দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একাধিক নেতা বলছেন, যেখানে দলের সাংগঠনিক অবস্থা কিছুটা দুর্বল, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আছে, মূলত সেসব জায়গাতেই এবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে গোয়েন্দা ব্যর্থতাও কাজ করেছে।
কুমিল্লার ঘটনার পরই সেখানে ছুটে যায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল। এর নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের হাত আছে। একেবারে পরিকল্পনা ও ছক করে এসব হামলা করা হয়েছে। এতে কিছু গোয়েন্দা ব্যর্থতাও থাকতে পারে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে দায়ীদের যেকোনো মূল্যে শাস্তির আওতায় আনা হবে। সারা দেশে দলের নেতা-কর্মীদেরও পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে আবু সাঈদ আল মাহমুদের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি চাঁদপুর ও কুমিল্লা হয়ে এখন নোয়াখালী আছে। এই দলে আছেন দলের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ, অর্থ সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান। তাঁরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করছেন।
সাধারণভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগের ‘ভোটব্যাংক’ হিসেবে পরিচিত। দলের নেতারা সব সময় এই বক্তব্য দেন, সরকারে আওয়ামী লীগ থাকলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ‘নিরাপদ’ থাকে। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, ভোলা, কুমিল্লার মুরাদনগর, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গত এক যুগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারে নাÑএমন প্রচার বিরোধী দলগুলো চালালে রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন নেতারা। তাঁরা বলছেন, সাম্প্রদায়িক এসব হামলা যে সরকার ও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ, সেটাই প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াত যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে এবং এর পেছনেও তাদের ষড়যন্ত্র থাকতে পারে, সেটা প্রচার করা হবে।
এবার পূজায় হামলার ঘটনা নিয়ে বিএনপিসহ অন্য দলগুলো সরকারকে অভিযুক্ত করে যে প্রচার চালাচ্ছে, তা রাজনৈতিকভাবেও মোকাবিলা করার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ। এজন্য ১৪-দলীয় জোট এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে ১৪ দলের শরিক তরীকত ফেডারেশন হামলার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।
কিন্তু বিএনপি এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে উল্টো সরকারকেই দোষারোপ করছে। সোমবার দুপুরে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের ২২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শেরেবাংলা নগরস্থ প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও জিয়ারত শেষে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দ্রব্যমূল্যসহ নানা ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতেই সরকার কুমিল্লার ঘটনা ঘটিয়েছে।