দেশে বর্তমানে ব্যাপক হারে পণ্য আমদানি হচ্ছে। আর আমদানির চাপে লাফিয়ে বাড়ছে ডলারের দাম। তার বিপরীতে মান হারাচ্ছে টাকা। ইতিমধ্যে ডলারের দাম এ যাবতকালের সর্বোচ্চ পৌঁছেছে। মূলত করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় দেশে আমদানি চাপ বেড়েছে। তাছাড়া করোনার ভ্যাকসিনের আমদানির অর্থও পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে ওসব দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাড়তি ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে। পাশাপাশি গত ৩ মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিটেন্স কমছে। আবার প্রত্যাশা অনুযায়ী রফতানি আয়ও কম। সব মিলিয়ে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে ডলার চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ রয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকার পর চলতি বছরের আগস্টের শুরু থেকে হঠাৎ বাড়তে থাকে ডলারের দাম। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। ব্যাংকগুলোর নিজেদের মধ্যে লেনদেনর জন্য প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৬ টাকা। যা এ যাবতকালে ডলারের সর্বোচ্চ মূল্য। সেপ্টেম্বরের শুরুতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা ২০ পয়সা। আর আগস্টের শুরুতে ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। আগস্টের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে ৮০ পয়সা দর হারিয়েছে টাকা। বর্তমানে খোলাবাজার ও নগদ মূল্যে ডলার ৮৯ টাকা ৯০ পয়সা থেকে ৯০ টাকা ১০ পয়সায় কেনাবেচা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে রেকর্ড পরিমাণ এলসি খোলা হয়েছে। দেশের ব্যবসায়ীরা আগস্টে মোট ৭১৮ কোটি ৪০ লাখ ডলারের এলসি খুলেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৬১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা)। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের দুই মাসের (জুলাই-আগস্ট) হিসেবে এলসি খোলার পরিমাণ বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। ওই দুই মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানির জন্য ১ হাজার ২১৩ কোটি (১২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। আর গত বছরের একই সময়ে খোলা হয়েছিল ৮১৬ কোটি ৩০ লাখ ডলারের এলসি। তার আগে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার কেনায় রেকর্ড গড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২০-২১ অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সব মিলিয়ে প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনে। তার আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত অর্থবছরের আগে সেটিই ছিল সর্বোচ্চ ডলার কেনার রেকর্ড। আর্থিক খাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনে। কিন্তু বর্তমানে আমদানি দায় মেটাতে ব্যবসায়ীদের থেকে দেশী ও বিদেশী খাতের বেশিরভাগ ব্যাংক প্রতি ডলারে ৮৫ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত নিচ্ছে। তবে নগদ ডলারের মূল্য বেশিরভাগ ব্যাংকে ৮৭ টাকার উপরে রয়েছে। কয়েকটি ব্যাংকে নগদ ডলারের মূল্য ৮৮ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
সূত্র আরো জানায়, যখন বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেশি ছিল তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনেছে। এখন সরবরাহ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করছে। চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ জুলাই থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ৭৮৬ মিলিয়ন ডলার (৭৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার) বিক্রি করেছে। করোনা মহামারীর শুরুর দিকে প্রবাসী আয়ের চাঙ্গাভাব চলতি বছরের জুন থেকে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে ১৭২ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে। প্রবাসী আয়ের ওই অঙ্ক গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। তার আগে ২০২০ সালের মে মাসের দেশে ১৫০ কোটি ডলার সর্বনিম্ন রেমিটেন্স আসে।
এদিকে অর্থনীতিবিদদের মতে, আমদানি বাড়ায় ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে। গত অর্থবছরে প্রচুর রেমিটেন্স আসায় ডলারের সরবরাহ বেড়ে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে তেমনটি থাকবে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রেমিটেন্স বাড়েনি। গত আগস্ট মাসেও আগের তুলনায় কমেছে। সেপ্টেম্বরেও কমেছে। অন্যদিকে আমদানি অনেক বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। আর চাহিদা বাড়লে যে কোন পণ্যের দাম যেমন বাড়ে; ডলারের দামও তেমনি বাড়ছে। আর এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষপ করে ডলারের দাম বাড়ার সুযোগ করে দিয়ে ঠিক কাজটিই করছে। ফলে রফতানি খাতের ব্যবসায়ীরা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সেও ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। টাকার মান বেড়ে গেলে অর্থনীতির ওই দুই সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ত।
অন্যদিকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম জানান, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকায় দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও পণ্য আমদানি বেড়েছে। ওসব পণ্যের দায় পরিশোধ করতে বাড়তি ডলারের প্রয়োজন হচ্ছে। সেজন্য দাম বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ রয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ডলার সরবরাহ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। করোনাভাইরাস থেকে দেশের মানুষকে সুরক্ষায় বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা কিনছে সরকার। সম্প্রতি কোভিড-১৯-এর টিকা কেনার জন্য ২ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা ছাড় করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনে ওই অর্থ ছাড় করা হয়েছে।