দেশের গ্রাম বা শহরাঞ্চলে বৃষ্টির পানিকে (রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং) খাবার পানি ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। যদিও ভূগর্ভস্থ পানি বা দূষণমুক্ত পানির বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের জন্য সরকারের বিভিন্ন মেয়াদি প্রকল্প রয়েছে। তার মধ্যে কিছু প্রকল্প এখনো চলমান। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, খাবার পানির জন্য বৃষ্টির পানির ব্যবহার কমে এসেছে। আর সেজন্য অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি পানির এ উৎসকে জনপ্রিয় করতে যথাযথ পদক্ষেপের অভাবের কথা উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালে দেশে খাবার পানির উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানির ব্যবহার শূন্য দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। আর গ্রামাঞ্চলে খাবার পানিতে বৃষ্টির পানির উৎস কমে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ দাঁড়ালেও শহরে দাঁড়িয়েছে শূন্য শতাংশে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে বাংলাদেশে নিরাপদ পানির সঙ্কট প্রকট হচ্ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ওসব এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। আবার অনেক এলাকায় ভূগর্ভের পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ সহনীয় মাত্রারও বেশি। কেবল রাজধানীতেই ভূগর্ভস্থ পানির অপরিমিত ব্যবহারের কারণে পানির স্তর প্রতি বছর প্রায় ৫ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বৃষ্টির পানি সুপেয় ও নিরাপদ পানির একটি বিকল্প উৎস হতে পারে। সেজন্য সরকারের নানা উদ্যোগও আছে। কিন্তু ওসব উদ্যোগ এখনো তেমন উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে বৃষ্টির পানির ব্যবহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র জানায়, দেশে ৭ ধরনের উৎস থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করা হয়। তার মধ্যে বৃষ্টির পানিকে উৎস হিসেবে ব্যবহারের হার কমেছে। ২০১৮ সালে গ্রামাঞ্চলে খাবার পানির শূন্য দশমিক ৬ ও শহরে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃষ্টির পানি থেকে আসতো। ২০১৯ সালে ওই হার কমে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০২০ সালে গ্রামাঞ্চলে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ খাবার পানি বৃষ্টি থেকে নেয়া হলেও শহরে তা শূন্যে নেমেছে। খাবার পানি হিসেবে বৃষ্টির পানির ব্যবহার খুলনা বিভাগে সবচেয়ে বেশি হতো। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে বৃষ্টির পানি থেকে ওই বিভাগটিতে আড়াই শতাংশ খাবার পানির জোগান আসতো। ২০১৯ সালে ওই হার ৩ শতাংশে দাঁড়ালেও ২০২০ সালে এসে তা কমে ১ শতাংশের নিচে দাঁড়িয়েছে। গত বছর পর্যন্ত বরিশালের কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি ধরে রেখে তা দিয়ে কাজ চালানো হয়। কিন্তু অন্য শহরগুলোতে বৃষ্টির পানি ধরা হয় না বললেই চলে। অথচ বৃষ্টির পানি ধরে রাখা গেলে তা দিয়ে সহজেই একটি পরিবারের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানো সম্ভব। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা বছরের অন্য সময় ব্যবহারের পদ্ধতি বেশ পুরনো। সাধারণত বাড়ির ছাদ থেকে ছাঁকনির মাধ্যমে পাইপ দিয়ে বৃষ্টির পানি নির্দিষ্ট স্থানে (যেমন পানির গভীর কুয়ায়) জমানো হয়। তারপর তা নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে ৬৩ হাজারের কিছু বেশি লোকসংখ্যার ৫৩ বর্গকিলোমিটারের দেশ বারমুডা। দেশটির মানুষ মূলত সংরক্ষণ করা বৃষ্টির পানি ব্যবহার করেই জীবন ধারণ করে। তারা প্রায় ৩০০ বছর ধরে খাবার পানি হিসেবে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করছে। বাংলাদেশেও প্রায় ২৫ বছর আগে সুপেয় পানির জন্য এ পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। দেশের উপকূলীয় জেলায় প্রথমে শুরু হলেও পরে বিভিন্ন স্থানে রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি কিছুটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে দেশে নিরাপদ খাবার পানির উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে কাজ চলমান। বর্তমানে ৩০টির বেশি প্রকল্পে পৌর ও গ্রামীণ এলাকায় পানি, স্যানিটেশন, পয়োনিষ্কাশনসহ বেশ কয়েক ধরনের কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে পানি সরবরাহ প্রকল্পের অধীনে শেষ পর্যায়ে দেড় হাজারেরও বেশি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং কূপ স্থাপন করার কাজ। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগ বৃষ্টি থেকে খাবার পানি সংগ্রহের কাজ করছে। তাছাড়া ৪ থেকে ৫ বছর মেয়াদি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের আরো একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়, পানি সম্পদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় গ্রাম ও শহরে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য কাজ করছে। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় চলতি বছরও দুটি প্রকল্প নেয়ার কথা বলেছে। একই সঙ্গে দেশী ও বিদেশী উন্নয়ন সংস্থাও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। দেশীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডরপ পানিই জীবন নামে দক্ষিণাঞ্চলে একটি কর্মসূচি পরিচালনা করছে। সংস্থাটি ২০১৭ সালে খুলনা-বাগেরহাট এলাকায় কার্যক্রম শুরু করে। তারা স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছে। ওসব অঞ্চলে এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক সুবিধাভোগী তাদের সুবিধা ভোগ করেছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) পানি, স্যানিটেশন ও পয়োনিষ্কাশন কর্মসূচি কমিটির সদস্য সচিব ড. তানভীর আহমেদ জানান, শহর ও গ্রামের মানুষের পানি ব্যবহারের ক্ষেত্র এক নয়। কেবল খাবার পানির জন্যই নয়, অন্যান্য কাজের জন্যও বৃষ্টির পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে। বৃষ্টির পানির ব্যবহার বেশ সহজও। কেবল সাধারণ ফিল্টার ব্যবহার করেই ওই পানি পানের উপযোগী করা যায়। সেজন্য বাড়তি কোনো রাসায়নিক বা প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় না। ওই উৎসকে জনপ্রিয় করতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
অন্যদিকে জাতীয় পানি নীতিতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে বিকল্প উৎসের কথা বলা হলেও বৃষ্টির পানির বিষয়ে তেমন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি বলে মন্তব্য করে ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল আলম জানান, উপকূলে লবণ পানি ও অন্যান্য অঞ্চলে আর্সেনিকের দূষণ রয়েছে। তাতে নলকূপ বেশি ব্যবহার করা হয়। তবে নলকূপের বিকল্প হিসেবে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং গুরুত্বপূর্ণ। শহরাঞ্চলের জন্য রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং জরুরি। বহুতল ভবনের ছাদে এর ব্যবস্থা রাখার জন্য নতুন বিল্ডিং কোডে বলা হয়েছে। তবে এ পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করতে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
একই প্রসঙ্গে ওয়াটারএইড বাংলাদেশে পরিচালক হাসিন জাহান জানান, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমাতে হলে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের বিকল্প নেই। তবে মানুষের কাছে অন্য উৎস থাকলে তারা স্বাভাবিক নিয়মেই বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভরশীল হতে চাইবে না। সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষের কাছে এর প্রয়োজনীয়তার কথা পৌঁছাতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানোর বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইফুর রহমান জানান, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং বর্তমানেও চলমান রয়েছে। নতুন পরিকল্পনাও করা হয়েছে। দৈনন্দিন ব্যবহারের মাত্র ৫ শতাংশ হলো খাবার পানি। গ্রামাঞ্চলে উপরিভাগের পানির স্তর সব সময় এক রকম থাকে না। তাই নলকূপ বা গভীর নলকূপ বসানো হয়। তাতে সুবিধাভোগীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য যে অবকাঠামো দরকার তা নেই। গ্রামের বাড়িগুলো এলোমেলো। এক হাজার একরের কোনো গ্রামে বাড়িগুলো একই সারি বা এক স্থানে নয়, বরং এলোমেলো। অর্থাৎ বিদেশের মতো সাজানো নয়। তাতে রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিংয়ের ব্যবস্থা করলেও পাইপলাইন বসানো যায় না। একই সঙ্গে পাইপলাইন বসানো হলেও তাতে যে তদারকি ও ব্যবস্থাপনায় যে খরচ হয় তা গ্রামের মানুষ বহন করতে পারে না। সেজন্য যেসব স্থানে নলকূপ বসানো যায় না সেসব স্থানে বৃষ্টির পানির ব্যবস্থা করা হয়।