এবার এমপি’র নির্দেশ অমান্য করে পাকা ইমারত নির্মাণ হচ্ছে খুলনার পাইকগাছায় কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্সের নির্ধারিত স্থানে। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত নির্ধারিত সরকারি জায়গায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে গত বছর ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবসে এর ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ উদ্বোধন করেন সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক। ঐদিন মন্ত্রী ছাড়াও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সচিব তপন ঘোষ, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সচিব ইউসুফ হারুন, স্থানীয় এমপি আক্তারুজ্জামান বাবু উপস্থিত ছিলেন। এরআগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর তত্ত্বাবধায়নে উপজেলা কানুনগো, সার্ভেয়ার, ইউএলএও এবং স্থানীয় সার্ভেয়াররা কয়েক দফা মাপ-জরিপ করে সরকারি চরভরাটি সীমানা নির্ধারণ করে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের নির্ধারিত স্থান শনাক্ত করেন। এরপর ৯ডিসেম্বর মন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উদ্বোধনের পর থেকে ঐ জায়গা নিজেদের দাবি করে সেখানে কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নেয় আধুনিক কপিলমুনি প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ভাই কুঞ্জু বিহারী সাধু ওয়ারেশরা। এরপর থেকে দফায় দফায় সরকারি পক্ষে সেখানে কখনো লাল পতাকা আবার মালিক পক্ষে কখনো সবুজ পতাকা। এভাবে পতাকা চালাচালিসহ দখল-বেদখলের ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে গত ১৬অক্টোবর দুপুরে খুলনা-৬ এমপি আক্তারুজ্জামান বাবুসহ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মমতাজ বেগম, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শাহরিয়ার হক, উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল মন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান শিহাব উদ্দীন বুলু, কপিলমুনি কলেজ অধ্যক্ষ হাবিবুল্ল্যাহ বাহার, উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সমীরণ সাধু, সাধারণ সম্পাদক আনন্দ মোহন বিশ্বাস, ইউপি চেয়ারম্যান কওছার আলী জোয়াদ্দার, কাজল কান্তি বিশ্বাস, আওয়ামীলীগ নেতা যুগোল কিশোর দে, শেখ ইকবাল হোসেন খোকন, কপিলমুনি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজু, সাধন ভদ্র, বীর মুক্তিযোদ্ধ শেখ জামাল হোসেন, সালামত উল্যাহসহ স্থানীয় সাংবাদিক, সূধীজনদের নিয়ে উক্ত সম্পত্তির অবৈধ দখলদারদের সাথে ঘটনাস্থলে বসাবসির মাধ্যমে সকল সংকটের সমাধান করেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ইতিহাস সংরক্ষণে সরকার সারাদেশে ৫টি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নিলে স্থানীয় সাংসদ আক্তারুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয়ের সাবেক সচিব তপন ঘোষ, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সচিব ইউসুফ হারুনসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কপিলমুনিতে এর একটি কমপ্লেক্স নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে পাইকগাছা সাবেক ইউএনও, এসিল্যান্ডদের তত্ত্বাবধায়নে সংশ্লিষ্ট কানুনগো, সার্ভেয়ার, ইউএলএও, মুক্তিযোদ্ধসহ স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে অন্তত ১০ বার মাপ-জরিপপূর্বক কপোতাক্ষ নদের চরভরাটি খাস জায়গায় উক্ত কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণ করেন। এরপর ঐ ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। এদিকে ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপনের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে নির্ধারিত জায়গা নিজেদের মালিকানাধীন বলে দাবি করে সেখানে প্রাচীর ও কাটা তারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নেয় স্থানীয় অমিত ও অভিজিত সাধু গং। অন্য পাশে পাকা ইমারত নির্মাণের কাজ শুরু করেন তাদের আরেক ভাই অনুপম সাধু। যার মধ্যে স্থানীয় এক দরিদ্র পরিবারের খরিদা রেকর্ডীয় জমিও রয়েছে। যা এস এ ১৯৩ খতিয়ানের ৪২৬/৫৯৩ দাগের মধ্যে সম্পৃক্ত। অবৈধ দখলের ঘটনায় চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তৎকালীন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরাফাতুল আলমের নেতৃত্বে কাটাতারের বেড়া অপসারণপূর্বক ঐ সম্পত্তির অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়। তবে এতেও খ্যান্ত হয়নি দখলদাররা। সুযোগ বুঝে সম্প্রতি রায়সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ভ্রাতা কুঞ্জুবিহারী সাধুর ওয়ারেশরা ফের ঐ সম্পত্তি নিজেদের বলে দাবি করে সেখানে কাটাতারের ঘেরা-বেড়া দিয়ে দখলে নেয়। উল্লেখ্য, রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু ভাই কুঞ্জুবিহারী সাধু প্রথম স্ত্রীর বড় ছেলে নারায়ন সাধু বা তার ওয়ারেশদের তথ্যগোপণ করে তার দ্বিতীয় পক্ষের ৪ ছেলে ও তার ওয়ারেশরা সমুদয় সম্পত্তির রেকর্ড নিজেদের নামে করিয়ে নিয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বন্দোবস্ত নিয়ে রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধুর নামীয় ৪৮শতক জমি ও তার উপর সকল স্থাপনাও রয়েছে তাদের দখলে। তথ্যানুসন্ধানে জানাযায়, ২০১৩ সালে কপোতাক্ষ নদের চরভরাটি নাছিরপুর মৌজার খাস খতিয়ানের ৫৯৫ দাগের কমপ্লেক্স নির্ধারিত স্থানের বিস্তীর্ণ সম্পত্তির মধ্য থেকে স্থানীয় জনৈকা মালঞ্চ নামের এক গৃহ ও ভূমিহীন মহিলা মিস কেস নং-৮৭৬/১২-১৩ মাধ্যমে ১০শতক খাসজমির ডিসিআর প্রাপ্ত হন। তবে বরাবরই ডিসিআর প্রাপ্ত হয়েও ঐ সম্পত্তি দখল নিতে গিয়ে ব্যর্থ হন ঐ মহিলা। এ নিয়ে আদালতে একাধিক মামলা-পাল্টা মামলারও উদ্ভব হয়। বিষয়টি জেলা প্রশাসক বরাবর অবহিত ও আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ৩০জানুয়ারি ২০১৮, ০৫.৪৪.৪৭০০.০৩১.৩৩.০০১.১৮-১৪৫৫নং স্মারকে দখল ও সীমানা বুঝে দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাইকগাছাকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ মোতাবেক স্থানীয় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে মহিলা বন্দোবস্তকৃত সম্পত্তির দখল নিতে গেলেও বাঁধার মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হন। এরপর গত বছরের ৫মে পুনর্দখল বুঝে পেতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে ইউএনও ৬মে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে কপিলমুনি ভূমি অফিসের সাবেক ইউএলএও মো. জাকির হোসেন এবং স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির এসআই বাবুল হোসেনকে নির্দেশ দেন। যার প্রাপ্তি নং-২৯৪। ইউএনও অনুমতিতে স্থানীয় ইউএলও-স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় ১৪মে সকালে কপোতাক্ষ তীরের বন্দোবস্তপ্রাপ্ত খাসজমিতে তৃতীয় দফায় ঘর বাঁধতে গিয়েও দখলদারদের বাধার সম্মুখীন হন তারা। ঐ ঘটনায় ১৬মে পাইকগাছা বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্থানীয় দখলদারদের একজন তপন কুমার সাধু ছেলে অমিত সাধু ওরফে শান্ত বাদী হয়ে স্থানীয় ইউএলএও মো. জাকির হোসেন ও স্থানীয় এক সাংবাদিকসহ কয়েকজনকে আসামী করে একটি মামলাও করেন। যা পিবিআই তদন্তে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় সংসদ সদস্যর মধ্যস্থতায় মালঞ্চকে অন্যত্র পূণর্বাসন করলে ফের ঐ সম্পত্তির দখলে যান অমিত ওরফে শান্ত সাধু গং। এরপর ৯ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত দিবসকে সামনে রেখে সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক রণাঙ্গন কপিলমুনিতে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নিলে নড়ে চড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে প্রশাসনের দফায় দফায় বৈঠকে ঐ এলাকা সরকারি হিসেবে নির্ধারিত স্থান বলে চিহ্নিত ও কয়েক দফায় সার্ভেয়াররা জরিপ করে সীমানায় লাল পতাকা টানিয়ে দেন। এরপর ৯ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী এর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন। তবে এরপরও বন্ধ ছিলনা এর দখল কার্যক্রম। প্রথমত ভিত্তিপ্রস্থরসহ গোটা এলাকা ও পরে উপজেলা কানুনগো মোজাম্মেল হক ও সার্ভেয়ার কওছার আলীর তত্ত্বাবধায়নে স্থানীয় সার্ভেয়ারদের দিয়ে মাপ-জরিপ করিয়ে কমপ্লেক্স সরকারি সম্পত্তির সিংহভাগ সীমানায় ঢুকে পড়ে তারা। এবার তারা ভিত্তিপ্রস্থরকে তাদের সীমানার বাইরে রেখে কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়। দক্ষিণ প্রান্তে সাধু পরিবারের একজন অনুপম সাধু রাতারাতি পাকা ইমারত নির্মাণ করে। এদিকে গত ১৬অক্টোবর এমপিসহ উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে অমিত ওরফে শান্ত গংদের নিয়ে বসাবসিতে তাদের ঘেরা-বেড়া উঠিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যেখানে তারা ঐ সীমানা থেকে তাদের ঘেরা-বেড়া উঠিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও এমপিসহ উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশনা অমান্য করে টিনের বেড়ার মধ্যে ইতোমধ্যে তারা দ্রুত পাকা ইমারত নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। উল্লেখ্য, প্রথমত কানুনগো ও সার্ভেয়ার মাপ-জরিপ করে সীমাণা নির্ধারণের পর সেখানে মন্ত্রী ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করলেও পরে ঠিক তাদেরই তত্ত্বাবধায়নে মাপে সরকারি সীমানার মধ্যে সিংহভাগ জায়গা মালিকানা বলে চিহ্নিত হয়। বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা যায়, ’৮০-এর দশক থেকে প্রথমে কপোতাক্ষের ব্যাপক ভাঙন ও পরবর্তী পর্যায়ে নাব্যতা হ্রাসে কপিলমুনি সদরের কপোতাক্ষের তীর জুড়ে গড়ে ওঠে বিস্তীর্ণ চরভরাটি খাসজমি, যা সরকারের সর্বশেষ মানচিত্রে ১নম্বর খাস খতিয়ানের ৫৯৫ দাগে চিহ্নিত হয়। দাগের পাশেই এস এ ১৯৩ খতিয়ানে ৪২৫, ৪২৬/৫৯৩ দাগে ননীবালা অধিকারীর খরিদা জমি এবং এস এ ১৯২ খতিয়ানে ভিপি “ক” তালিকাভূক্ত ০.৪৮ একর জমির অংশবিশেষসহ কুঞ্জুবিহারী সাধুর ওয়ারেশদের রেকর্ডীয় জমি। প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ডিসেম্বর রাজাকারদের অন্যতম প্রধান রাজাকার ঘাঁটি কপিলমুনি রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা আটক করেন ১৫৫ জন রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীকে। রাজাকার ঘাঁটি (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংসের পথে) থেকে উদ্ধৃত বিভিন্ন কাগজপত্র পর্যালোচনায় এ ঘাঁটির রাজাকারদের হাতে লেখা ১হাজার ৬০১জন শহীদের তালিকা। এছাড়া রাজাকারদের পরবর্তী টার্গেট হিসেবে এলাকার আরো ১হাজার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের তালিকা পাওয়া যায়। ক্যাম্প থেকে এদিন দেয়ালে পেরেকবিদ্ধ সৈয়দ আলী গাজী নামে এক মুক্তিযোদ্ধার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার হয়। আতœসমর্পণের খবরে সহচরী বিদ্যা মন্দির স্কুল মাঠে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের গণআদালতে এদিন ১৫১ জন রাজাকারের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন গণআদালতের রায়ে এক সঙ্গে এত সংখ্যক রাজাকারের শাস্তির সম্ভবত এটাই একমাত্র ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপুঞ্জ অবগত হওয়ার পর সর্বশেষ ৯ডিসেম্বর ’২০ কপিলমুনি মুক্ত দিবসের অনুষ্ঠানে সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আর এগার মাসেও কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ শুরু হয়নি। আর অবৈধ দখলদাররা এমপি’র নির্দেশ অমান্য করে পাকা ইমারত নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে।