করোনার নেতিবাচক প্রভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গত দেড় বছরে বকেয়া এলসির পরিমাণ প্রায় ১৪০ কোটি ডলার বেড়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ১২ হাজার ৪০ কোটি টাকারও বেশি। ওসব দেনা পরিশোধ উদ্যোক্তাদের সক্ষমতার অভাবে স্থগিত করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফায় ওসব দেনা পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়েছে। গত ১ অক্টোবর থেকে বেশিরভাগ বকেয়া এলসি পরিশোধ করতে হচ্ছে। তাছাড়াও স্থগিত অন্যান্য বৈদেশিক ঋণের কিস্তিও এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। ওসব কারণে ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ করে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। তাতে ডলার দাম এখন ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে প্রায় ১৪০ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ৪০ কোটি টাকার এলসির দেনা বকেয়া পড়েছে। তার মধ্যে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১২৪ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১৪ কোটি ডলার। করোনার ভয়াবহতা গত বছরের তুলনায় এবার কম হওয়ার কারণে ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কম। যে জন্য এবার স্থগিত এলসির দেনাও কম বেড়েছে।
সূত্র জানায়, করোনার কারণে গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির ছিল। তবে অক্টোবর থেকে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হলেও মন্দার ধাক্কা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের নীতি সহায়তা দিতে এলসি পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়। গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন দফায় সময় বাড়ানো হয়। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানে। ফলে এপ্রিল থেকে ব্যবসা বাণিজ্য ফের স্থবির হয়ে আগস্ট পর্যন্ত চলে। ফলে দুই দফায় সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এলসির দেনা পরিশোধ স্থগিত করা হয়। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ বা বিদেশি ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রায় নেয়া ঋণে খোলা এলসির দেনা পরিশোধের মেয়াদও দুই দফা বাড়ানো হয়। ওসব কারণে জুন পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণে খোলা এলসির দেনা পরিশোধ করতে হয়নি। সেগুলো জুলাই থেকে পরিশোধ শুরু হয়েছে। আর বিদেশি ব্যাংকের ঋণের খোলা এলসিসহ অন্যান্য বকেয়া এলসিও একই সময়ে পরিশোধ শুরু হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে খোলা ব্যাক টু ব্যাক এলসি (রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য খোলা এলসি) দেনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬১ কোটি ডলার। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ওই খাতে কোনো এলসি বকেয়া ছিল না। বর্তমানে স্থগিত এলসির দেনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ কোটি ডলার। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে ছিল ৩৯ কোটি ডলার, ২০১৭ সালে ছিল ৪৫ কোটি ডলার। গত কয়েক বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে স্থগিত এলসির দেনা। সেগুলো এখন পরিশোধ করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের নীতিমালা অনুযায়ী, এলসি খোলার সময় ক্রেতা-বিক্রেতার পক্ষে ব্যাংকের মধ্যে চুক্তি হয়। তাতে এলসির দেনা কিভাবে পরিশোধ করা হবে তার শর্ত উল্লেখ থাকে। তবে নীতিমালা অনুযায়ী তা ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। তা না করলে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে উদ্যোক্তা খেলাপি হয়ে পড়বে। তখন আর নতুন এলসি খুলতে পারবে না। যে কারণে এলসির দেনা শোধে কেউ সাধারণত পিছিয়ে থাকেন না। আর কোনো কারণে উদ্যোক্তা পরিশোধ না করতে পারলেও ব্যাংক ফোর্স লোন সৃষ্টি করে এলসির দেনা শোধ করে দেয়। যে কারণে আগে বকেয়া এলসি খুবই কম ছিল। আর যেগুলো বকেয়া থাকতো সেগুলোও ৬ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে বেশির ভাগই মিটে যেত। কিন্তু করোনার কারণে স্বয়ং কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এলসির দেনা শোধের মেয়াদ বাড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এলসির দেনা শোধ বা রপ্তানির বিল দেশে আনার মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে।
এদিকে এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদদের অভিমত, যে কোনো দুর্যোগে হঠাৎ করে মুদ্রার হাতবদল স্থবির হয়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে অর্থের জোগান বাড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। যেমনটি ২০০৮ সালের মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দার সময়ে হয়েছিল। ওই সময়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলারের জোগান বাড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। পরে দেয়া অর্থ ফেরত নেয়া হয়। গত করোনায়ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিশ্বের প্রায় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বাড়িয়েছে। সেগুলো এখন ধীরে ধীরে পরিশোধ হচ্ছে। তাতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, ব্যবসা চালু রাখতে হলে এলসির দেনা নির্ধারিত সময়েই শোধ করতে হবে। তা না করলে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসা এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না। যে জন্য আগে বকেয়া এলসি ছিল খুবই কম। করোনার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সহায়তা দেয়ায় ওই দেনা বেড়েছে। তবে এখন রপ্তানি স্বাভাবিক হওয়ায় আগের দেনা সমন্বয় করা হচ্ছে।