কমলাপুর রেল স্টেশন সংলগ্ন ডেমু ট্রেনের ওয়ার্কশপে দীর্ঘদিন ধরেই বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে ১০টি ডেমু ট্রেন। ওসব ট্রেনের অধিকাংশের দরজা-জানালা ভাঙ্গা। অযতেœ পড়ে থাকা ডেমুগুলো মেরামত করারও কোন উদ্যোগ নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় ওসব ট্রেন রেলওয়ে সচলও করতে পারছে না। এমনকি বর্তমানে যে ৩ সেট ডেমু সচল রয়েছে সেগুলোতেও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে। ওসব ট্রেন প্রায়ই বিকল হয়ে যায়। তখন অন্য ট্রেন দিয়ে টেনে ওয়ার্কশপে নিতে হয়। ফলে ওসব ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মাঝপথেই বিকল হয়ে পড়ায় যাত্রীদের ডেমু থেকে নেমে যেতে হয়। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ডেমু ট্রেন স্বল্প দূরত্বের যোগাযোগের জন্য রেল যাত্রীদের চাহিদার বিপরীতে কেনা হয়েছিল। আর প্রথমদিকে ট্রেনগুলো বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ডেমু ট্রেনগুলোর রেলের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত ২০১৩ সালে ৬৫৪ কোটি টাকায় ২০ সেট ডেমু (ডিজেল ইলেক্ট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন কেনা হলেও এখন ১৭টিই অচল। বাকি ৩টি খুঁড়িয়ে চলছে। অথচ ৬৫৪ কোটি টাকায় কেনা ওই ট্রেনগুলো কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ বছর সচল থাকার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। চীন থেকে কেনা ওসব ট্রেন খুব শিগগির সচল করারও কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। অথচ ওই পরিমাণ টাকা দিয়ে সাধারণ ট্রেনের ১২০টি এসি বগি কেনা যেত। আর প্রতিটি এসি বগি থেকে রেলের বছরে গড়ে আড়াই কোটি টাকা আয় হয়।
সূত্র জানায়, ডেমু ট্রেন কেনা ছিল একটি আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত। কোন ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই না করেই ওই ট্রেনগুলো কেনা হয়েছিল। চীনের পরিস্থিতি আর ঢাকার পরিস্থিতি যে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী তা আমলেই নেয়া হয়নি। ফলে ডেমুগুলো দেশে আনার পর চোখে পড়ে স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের সিঁড়ি আড়াই ফুট উঁচু। তাতে নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের ওঠানামায় সমস্যা হয়। ট্রেনের ভেতরের কাঠামোও যাত্রীবান্ধব নয়। এমন ধরনের জটিলতায় ডেমু জনপ্রিয়তার পরিবর্তে উল্টো দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ চীন থেকে কেনা ওসব ডেমু ট্রেন সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির। প্রতিটি ট্রেনের মেয়াদকাল ছিল ৩০ বছর। কিন্তু উদ্বোধনের কিছুদিন পর এক এক করে ট্রেনগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন দেশে এমন ধরনের ট্রেন সচলে ওয়ার্কশপ ও যন্ত্রপাতি নেই। ফলে ট্রেন নষ্ট হলে সারানোর ব্যবস্থাও নেই। এখন ওই ডেমু ট্রেনগুলো রেলওয়ের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেমু কেনা হয়েছিল মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের স্বল্প দূরত্বে অর্থাৎ ২০ কিলোমিটার যাতায়াতের জন্য। অথচ অন্য প্রতিটি রুট গড়ে ৯০ কিলোমিটারের বেশি ছিল। ফলে উদ্বোধনের কিছুদিনের মধ্যেই একের পর এক ট্রেন বিকল হতে শুরু করে। ডেমুর দুই দিক দিয়ে দুটি ইঞ্জিন থাকে। মাঝখানে একটি বগি। বগির পাশাপাশি ইঞ্জিন অংশেও যাত্রী বহন করা যায়। প্রতিটি ডেমুতে ১৪৯ জন বসে এবং ১৫১ জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু সেগুলো যখন উদ্বোধন করা হয়, তখন প্রতিটি ডেমুতে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী যাতায়াত শুরু করে। আর তাতেই দ্রুত সর্বনাশ ঘটতে থাকে। সঠিক সময়ে রক্ষণাবেক্ষণ না করে অযতœ অবহেলায় সেগুলোকে অচল করা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, স্বল্প দূরত্বের ডেমু ট্রেন ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে যাত্রী বহন করতে থাকে। মূলত ওই কারণেই ট্রেনগুলো অল্পদিনে বিকল হয়ে পড়ে। অন্যথায় এমন ধরনের ট্রেনের ইঞ্জিনে পাঁচ বছরের আগে হাত দেয়া লাগে না। মেরামত করে ২০ থেকে ২৫ বছর চালানো যায়। এমন চিন্তা থেকেই ২০১১ সালে ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনতে চীনের একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তার সঙ্গে শুল্ককর এবং ৩০ জন কর্মকর্তার বিদেশে ভ্রমণ-ভাতার খরচ যোগ হয়। ফলে সব মিলিয়ে খরচ দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি টাকা। পরে ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই সেট ট্রেন উদ্বোধন করেন। তারপরই ঢাকা-টঙ্গী, ঢাকা-জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, সিলেট-আখাউড়া, কমলাপুর-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা, নোয়াখালী-লাকসাম, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট, পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে বাকি ট্রেনগুলো চালু হয়। সেগুলো চালু হওয়ার পর রেল দাবি করে ২০১৩ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত ডেমু দিয়ে যাত্রী পরিবহন করে প্রায় ৩০ কোটি টাকা আয় করেছে। কিন্তু ডেমু ট্রেন পরিচালনায় প্রায় সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ ডেমুর আয়-ব্যয় সমান। কিন্তু যে ৬৫৪ কোটি টাকা খরচ করে ওই ট্রেন কেনা হয়েছে, ওই টাকা পুরোটাই জলে গেছে।
এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চীনের তৈরি ডেমু ট্রেন কেনার প্রকল্প সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। নীতিগত কিছু ভুলের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।