প্রতি বছর দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানিদের পকেটে চলে যাচ্ছে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট অঞ্চলের মাদক চোরাচালানের আন্তর্জাতিক রুট বাংলাদেশ। সেজন্য বাংলাদেশে দু’ডজন ধরনের মাদক প্রতিনিয়ত প্রবেশ করছে। আর অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর দেশ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার পাশাপাশি দেশেও মাদকাসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। সারাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। এক জরিপ দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে তাদের ১৫০ টাকার মাদক লাগে। ওই হিসাবে একজন মাদকাসক্ত বছরে ৫৪ হাজার ৭৫০ টাকার মাদক সেবন করে। আর দেশের ৭০ লাখ মাদকাসক্ত বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার মাদক সেবন করে। ওসব মাদকের পুরোটাই অবৈধভাবে দেশে আসছে। আর পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মাদকের বিরুদ্ধে সরকার জিরো টলারেন্স অবস্থানে থাকলেও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল অঞ্চলভুক্ত মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, আইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক এদেশে আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করলেও দেশে মাদকের চাহিদা থাকায় গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট ব্যবহার করে মাদক আসা বন্ধ হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মাদক পাচারকারী চক্র আফিম দিয়ে নানা ধরনের ক্ষতিকর মাদক তৈরি করে নানা কায়দায় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করছে। এদেশের মাদকসেবীরা ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন আর গাঁজার বাইরেও অন্তত ২৪ ধরনের মাদক সেবন করে। মাদকগুলো কোন সীমান্ত দিয়ে আসছে, কীভাবে আসছে- এসব তথ্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বার্ষিক প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে।
সূত্র জানায়, দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার হয়েছে। আর ওসব মাদকের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশী মদ, বিদেশী মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, ডিনেচার্ড স্পিরিট, তাড়ি, প্যাথেডিন, বুপ্রেনরফিন (টি ডি জেসিক ইঞ্জেকশন), ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বনোজেসিক ইঞ্জেকশন), মরফিন, আইচ পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাংগানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মাদকের মাফিয়া পরিচিত বড় ব্যবসায়ীদের কেউ ধরা পড়ে না। বরং তাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। আর তারা বিদেশ থেকেই এদেশে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।
সূত্র জানায়, মাদকের প্রবেশপথ হিসেবে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৩২টি জেলাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, টাকি, বশিরহাট, স্বরূপনগর, বাদুড়িয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, বনগাঁও, পেট্রাপোল, হেলেঞ্চা, ভবানীপুর, রানাঘাট, অমৃতবাজার, বিরামপুর, করিমপুর, নদীয়া, মালদাহ, বালুরঘাট, আরঙ্গবাদ, নিমতিতাসহ সীমান্ত সংলগ্ন প্রায় সব এলাকা দিয়ে ১৫টি পয়েন্টে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট এবং দিনাজপুরে মাদক ঢুকছে। ভারতের আসাম এবং মেঘালয়ের বাংলাদেশ ঘেঁষা এলাকাগুলোর ৪টি পয়েন্ট দিয়ে মাদক ঢুকছে কুড়িগ্রাম, শেরপুর, ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনায়। বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ভারতের অসম, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের ৪টি পয়েন্ট দিয়ে সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং ফেনীতে মাদক ঢুকছে। তাছাড়াও ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর হয়ে নওগাঁয় ফেনসিডিল পাচারের নতুন রুটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
সূত্র আরো জানায়, প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে খুব সহজেই ভয়ঙ্কর মাদক আইস দেশে ঢুকছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের মধ্যবর্তী নৌপথ দিয়ে দেশে আসছে ভয়ঙ্কর মাদক আইস। কখনো আচার, কাপড়ের প্যাকেট আবার কখনো চায়ের ফ্লেভারের প্যাকেটে করে আনা হচ্ছে। ওসব মাদক চালান প্রথমে টেকনাফে কয়েক স্থানে মজুদ রাখা হয়। তারপর সুযোগ বুঝে বিভিন্ন যানবাহনে করে ঢাকায় আনা হয়। দেশের সবকটা বাহিনীর নজরদারি ও টহল থাকার পরও আসছে এই মাদক। বর্তমানে দেশে সবচেয়ে বড় আলোচিত মাদক হলো আইস বা ক্রিস্টাল মেথ। ক্রিস্টাল মেথ বা আইসে ইয়াবার মূল উপাদান এমফিটামিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। তাই এই মাদক মানবদেহে ইয়াবার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতি করে। এ মাদক সেবনের ফলে অনিদ্রা, অতি উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, মস্তিষ্ক বিকৃতি, স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি ও লিভার জটিলতা এবং মানসিক অবসাদ ও বিষণœœতা তৈরি হয়। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এই মাদক প্রচলনের ফলে তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখা যায়। মাদকাসক্তরা নানা অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকরাও আসক্ত হয়ে পড়ছে।
এদিকে অতিসম্প্রতি রাজধানীতে আইসের একটি বড় চালান ধরা পড়েছে। ওই বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, সাম্প্রতিক সময়ে টেকনাফ কেন্দ্রিক কয়েকটি মাদক চক্র বেশ কিছুদিন ধরে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার থেকে মাদকদ্রব্য আইস নিয়ে আসছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। তারই ধারাবাহিকতায় র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা এবং র্যাব-১৫ এর যৌথ অভিযানে টেকনাফ কেন্দ্রিক আইসের সর্ববৃহৎ চালানসহ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়।