রাজধানীতে পায়ে হেঁটে চলাচলের জন্য যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো এখনো পথচারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। যেজন্য এখনো রাজধানীতে দুর্ঘটনায় মৃতে্যুর প্রায় তিন-চতুর্থাংশই পথচারী। অথচ পায়ে হাঁটা এখনো ঢাকার মানুষের যাতায়াতের প্রধানতম মাধ্যম। ঢাকার এ অরক্ষিত পথচারীদের নিরাপদ, সহজ ও সুন্দর পরিবেশে হাঁটার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশে প্রথমবারের মতো একটি প্রবিধানমালা তৈরি করা হচ্ছে। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ইতিমধ্যে ‘পথচারী নিরাপত্তা প্রবিধানমালা-২০২১’ শীর্ষক প্রবিধানমালার একটি খসড়াও তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে সড়ক নিরাপত্তা প্রবিধানমালা ২০২১-এর খসড়ায় ১৬টি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। ডিটিসিএকে প্রবিধানমালার খসড়াটি তৈরি করে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিয়েশন কোম্পানি (আইআইএফসি)।ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এবং বুয়েট সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এক গবেষণার তথ্যানুযায়ী ঢাকার রাস্তায় এখনো চলাচলকারীদের ৩০ শতাংশই পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যায়। আর রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ পথচারী। এমন পরিস্থিতিতে পায়ে হেঁটে সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে প্রবিধানমালাটি তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খসড়া প্রবিধানমালায় সব বয়সের ও শারীরিক সক্ষমতার পথচারীদের উপযোগী করে ফুটপাথ নির্মাণ, সহজে ও নিরাপদে সড়ক পারাপার, সড়ক পারাপারে গাড়ি নয় পথচারীদের অগ্রাধিকার, সড়কের যৌথ ব্যবহার, পথচারী নেটওয়ার্ক পরিকল্পনা, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসা ব্যয়ের ব্যবস্থার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, সড়ক পারাপারের ক্ষেত্রে গাড়ি নয়, পথচারীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারে পথচারী, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মতো বিষয়গুলোও ঠিক করে দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ৮৫টি ফুটওভারব্রিজ রয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশন আরো ৩৬টি নতুন ফুটওভারব্রিজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে একাধিক আন্ডারপাস রয়েছে। কিন্তু সঠিক অবস্থানে না থাকা ও ব্যবহারজনিত বিভিন্ন সমস্যার কারণে পথচারীদের অনেকেই ওসব ফুটওভারব্রিজ-আন্ডারপাস ব্যবহার করে না। সেজন্য প্রবিধানমালায় পথচারীদের সড়ক পারাপারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পদ্ধতি হিসেবে রাস্তায় সমতল পারাপারের সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া চার লেন বা তার বেশি লেনের ব্যস্ত সড়ক, মোটরওয়ে, এক্সপ্রেসওয়ে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) স্টেশন, এমআরটি (মেট্রোরেল) স্টেশনের মতো যেসব এলাকায় সমতল পারাপারের সুযোগ কম, সেসব এলাকায় ফুটওভারব্রিজ বা আন্ডারপাসের মতো অবকাঠামো তৈরি করা যাবে। তবে এসব আন্ডারপাস বা ফুটওভারব্রিজে র্যাম্প, লিফট বা চলন্ত সিঁড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। যাতে অক্ষম, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিরা সহজেই তা ব্যবহার করতে পারে। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী ঢাকায় ৪০০ কিলোমিটারের মতো ফুটপাথ আছে। তবে ওই ফুটপাথ নেটওয়ার্কের মধ্যে ব্যবহার উপযোগী ফুটপাথের পরিমাণ মাত্র ৬০ শতাংশ। বাকি ফুটপাথ অবৈধ দখল, সংস্কার না হওয়ার কারণে ব্যবহার অনুপযোগী। খসড়া প্রবিধানে পথচারীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ফুটপাথ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। ব্যবহারবিধির ভিত্তিতে ফুটপাথকে ৩টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ভাগগুলো হলো ভবন সম্মুখ জোন, পথচারী জোন ও রোড ফার্নিচার জোন। জোনগুলোয় ফুটপাথ এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে পথচারীরা সহজে, নির্বিঘেœ ও নিরাপদে তাদের গন্তব্যে যেতে পৌঁছতে পারে। পথচারীরা যাতে ফুটপাথ ব্যবহারে নিরুৎসাহিত না হয় সেজন্য সেগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রশস্ত ও সমতল করে তৈরির কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া ফুটপাতগুলোকে হাঁটার জন্য আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করে তোলার পাশাপাশি নিরাপত্তা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং রাতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, খসড়া প্রবিধানমালায় একটি পথচারী নেটওয়ার্ক পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে। ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী পথচারীরা বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনো গণপরিবহনে ওঠা পর্যন্ত এবং গণপরিবহন থেকে নেমে গন্তব্যে যাওয়া পর্যন্ত যাতে ফুটপাথ ব্যবহার করতে পারে সে ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। আরযেসব সরু রাস্তার পাশে ফুটপাথ নির্মাণের সুযোগ নেই, সেসব রাস্তার যৌথ ব্যবহার চালুর কথা বলা হয়েছে। সেক্ষেত্রে সেসব রাস্তায় গাড়ির একমুখী চলাচল এবং সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমিত রাখা যেতে পারে বলে মত দেয়া হয়েছে। তাছাড়া প্রবিধানে পথচারীদের দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণের বিষয়েও বলা হয়েছে। বলা হয়েছে প্রবিধানমালার আওতাধীন কোনো মোটরযান থেকে দুর্ঘটনার ফলে কোনো আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা ক্ষেত্রবিশেষে তার উত্তরাধিকার বা উত্তরাধিকারদের পক্ষে মনোনীত ব্যক্তি সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা ৫৩-এর অধীনে গঠিত আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসা খরচ পাবেন। আর খসড়া প্রবিধান অনুযায়ী পথচারী নেটওয়ার্ক পরিকল্পনা অনুসরণ করে ফুটপাথ, ফুটওভারব্রিজ, আন্ডারপাস, এসকেলেটর, লিফটসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো তৈরির দায়িত্ব পাবে সিটি করপোরেশন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। ওসব কর্তৃপক্ষের অবকাঠামোগুলো নিয়মিত পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখা ও রক্ষণাবেক্ষণেরও দায়িত্ব।
এদিকে ডিটিসিএর কর্মকর্তারা দেশে প্রথমবারের মতো প্রবিধানমালা তৈরির উদ্যোগটিকে বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহারকারীদের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা উদ্যোগটিকে স্বাগত জানালেও ঢাকার বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রবিধানমালাগুলো কতটুকু কার্যকর করা যাবে তা নিয়ে কিছুটা সন্দিহান। তাদের মতে, ঢাকার অপ্রতুল ও অপ্রশস্ত সড়ক, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা যোগাযোগ অবকাঠামো প্রবিধানমালার যথাযথ বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ খসড়া প্রবিধানে পথচারী পারাপারের পথনকশা তৈরির ক্ষেত্রে পথচারীদের বয়স, প্রকৃতি, শারীরিক সক্ষমতা এবং চলাচলের স্বাচ্ছন্দ্যের মতো বিষয়গুলোয় গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, পারাপার পথের নকশা এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যাতে পথচারীরা ন্যূনতম দূরত্ব অতিক্রম করে সহজে ও নিরাপদে যাতায়াত করতে পারে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান প্রবিধানমালাটিকে সময়োপযোগী এবং বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে মন্তব্য করেছেন। তবে ঢাকার মতো জনবহুল এবং অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা অবকাঠামোর কারণে প্রবিধান বাস্তবায়নে বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। তিনি জানান, ঢাকায় সড়কের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম। আবার সড়কের দুই পাশে স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। সেখানে সড়ক সম্প্রসারণ করে ফুটপাথ তৈরি করা কার্যত অসম্ভব। শহরের ভেতরে যে পরিমাণ ট্রাফিক, তাতে অনেক সড়কের যৌথ ব্যবহারেরও সুযোগ কম। সব মিলিয়ে সড়ক থেকে জায়গা বের করে সেখানে পথচারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলার কাজটি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। নীতিনির্ধারকরা যদি শক্ত অবস্থান নিতে পারে তাহলে তা সম্ভব। তবে প্রবিধানমালায় ফুটপাথ অবৈধ দখলের বিষয়ের কোনো করণীয় না থাকাটা হতাশাজনক।
এ প্রসঙ্গে ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান জানান, পরিসংখ্যান বলছে ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারীদের মৃত্যু হয় সবচেয়ে বেশি। তার একটা বড় কারণ অবকাঠামোগুলো খুব একটা পথচারীবান্ধব নয়। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পথচারীদের নিরাপত্তা এবং তাদের সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় যাতায়াতের সুযোগ করে দিতেই নতুন প্রবিধান তৈরি হচ্ছে। প্রবিধানটি চূড়ান্ত হওয়ার পর বাস্তবায়ন পর্যায়ে গেলে ডিটিসিএ অধিভুক্ত এলাকার মানুষ তার সুফল পাবে।