দেশে ঘনঘন জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। ক্ষতি হবে অর্থনীতির। করোনাপরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এবং জনস্বার্থে এ সময় জ¦ালানি তেলের দাম স্থিতিশীল রাখা রাষ্ট্রের একান্ত প্রয়োজন।
করোনা মহামারিতে একদিকে ডেঙ্গুর ছোবল ও কাজ হারিয়ে বেকাত্বের অভিশাপ অন্যদিকে পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন এখন ওষ্ঠাগত। বাংলাদেশে চাল, ডাল, আটা, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যেই দাম বাড়ার কারণে অসহায়, হতদরিদ্র ও কর্মহীন মানুষকে প্রতিদিন আধাপেটে থাকতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ভাত খাওয়া কমাতে পারলে চালের ব্যবহার অনেক কমে যাবে। বাংলাদেশকে মাছে ভাতে বাঙালি বলা হয়। সেই মাছ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিলুপ্তির পথে আর বাকি থাকল ভাত। সেটি খাওয়া না খাওয়া নিয়ে চলছে রাজনৈতিক আলোচনা। আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলো মধ্যে একটি খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তি যখন ভাত কম খাইতে বলে তা একটু চিন্তার বিষয়। হাটবাজার, মাঠে-ময়দানে অথবা রেলওয়েস্টেশনে একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখবেন যে, এ দেশে কত মানুষ ঠিক মতো না খেয়ে জীবনযাপন করে। স্যার, 'দশ টাকা দেন' আমি না খেয়ে আছি। রাস্তায় বের হলে এমন কণ্ঠ আমরা সবাই শুনতে পাই। কেন তারা আমাদের কাছে টাকা চায়? কেন প্রচন্ড শীতে অথবা গরমকালে রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকে? এর মধ্যে আছে কিছু ভারসাম্যহীন ব্যক্তি যাদের আমরা পাগল ও পাগলী বলে থাকি। তারা কী খায়? তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা কী? রাষ্ট্রযন্ত্র কেন নীরবতা পালন করে? দেশের প্রত্যেকটি নাগরিককে নিরাপত্তায় রাখা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব কতটুকু পালন করেন তার স্পষ্ট প্রমাণ রাস্তার ওই ছিন্নমূল মানুষগুলো। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সংহিতার আগুন দাউদাউ করে জ¦লে, নির্বাচনী সহিংসতায় মানুষ আহত ও নিহত হয় এমন খবর যখন পত্রপত্রিকার হেডলাইন হয়। তখন তেলে দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বেড়ে গেছে। তেলে দাম বাড়লে সমস্যা কী? দেশ তো উন্নয়নের পথে। তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের আয় বাড়বে তখন দেশ আরও উন্নয়নের পথে দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে যাবে। হয়তো বা কোনো একসময় এমন আজগুবি গল্প শুনতে হবে। উন্নয়নের কথা বলে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পণ্য বানিয়ে জনগণের পকেট কাটতে প্রস্তুত। তারা কী আসলে দেশপ্রেমিক। গত ৩ অক্টোবর বুধবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রতি লিটার ৮০ টাকা করেছে সরকার। ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের দামে সঙ্গে ডিজেলের নতুন দাম বৃদ্ধির ফলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। মানুষের জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশ-বিএডিসির হিসাবে, দেশের ১৩ লাখ ৭৯ হাজার সেচ পাম্পের ৮৬ শতাংশ অর্থাৎ ১১ লাখ ৯২ হাজার ডিজেল চালিত। বোরো মৌসুমে দেশে ১৬ লাখ টন ডিজেলের ব্যবহার হয় সেচে। লিটারে ১৫ টাকা করে ডিজেলের দাম বাড়ায় তাদের মাথায় হাত পড়েছে। সারাদেশেই রবি মৌসুমে শীতকালীন সবজি, ভুট্টা, ধান চাষে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কৃষক। এর মধ্যে আসছে বোরোর মৌসুম। আমাদের দেশের বেশির ভাগ কৃষক শুষ্ক মৌসুমে ফসল ফলাতে একেবারেই সেচের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির ফলে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এতে করে দেশে সব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির দিকে যাবে। জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে বাস বন্ধ রেখেছে মালিকরা। এমনকি তেলের দাম বাড়ায় প্রত্যেক পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। পাইকারি থেকে খুচরা সব পর্যায়ে অস্থিরতা তৈরি হবে। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশে কৃষকরাই প্রধানত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার সন্তানের পড়ালেখার খরচ বেড়ে যাবে। দিনের পর দিন ঋণগ্রস্ত হয়েছে জমি বিক্রি করে সর্বহারা হওয়ার পথে বসবে। মাথায় হাত দিয়ে কপালের দোষ বলে নিজেকে সান্ত¡না দেওয়ার ছাড়া উপায় থাকবে না। অন্য দিকে কৃষকের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে এক শ্রেণি লুটপাটের টাকায় পাহাড় গড়ে তুলবে। তখন তাদের টাকায় গড় হিসাব করে মাথাপিছু আয় বেড়েছে বলে আনন্দের উৎসবের মিছিল বের হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালে জ¦ালানি তেলের মূল্য কম হওয়ার কারণে চোরাকারবারিরা এখান থেকে প্রতিবেশী দেশেগুলোতে ডিজেল পাচার করছে। ফলে সীমান্তপথে চোরাচালান বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। তাহলে এ পদ্ধতিতে দেখে মনে হচ্ছে এ দেশে প্রশাসনের চেয়ে চোরাকারবারিদের শক্তি বেশি। সীমান্ত পথে চোরাচালান বন্ধ না করে তেলের দাম বাড়ানো কতটা যৌক্তিক। কৃষক যা উৎপাদন করে তার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। ব্রিটিশদের প্রায় দুইশত বছর শাসন আমলে কৃষকরাই শোষিত হয়েছে। এর পরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শোষণের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রেখে শোষণ করছে। শোষণমুক্তি জন্য এক সাগর রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশ পেয়েছি। সেই দেশে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে প্রত্যেকেই কৃষকবান্ধব সরকার বলে নিজেকে দাবি করে শোষণ করছে। কবে কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন আসবে? বর্তমানে আমাদের দেশে ভূমিহীন পরিবারের সংখ্যা ৪০ লাখ ২৪ হাজার ১৮৯টি- যা শতকরা হিসাবে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। কেন দিনের পর দিন ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়ছে? আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পরিবহণ নয়, কৃষি ও ব্যবসাতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। কৃষি ও কলকারখানার উৎপাদন খরচ বাড়বে। রপ্তানিতেও বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। আমরা দেখে আসতেছি প্রত্যেকটি সরকার ও ধনিক শ্রেণির সম্পর্ক এত বন্ধুত্বপূর্ণ কেন? বরাবরই ধনিক শ্রেণি আর লুটেরাদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকেন। কেন গরিব অসহায় ছিন্নমূল মানুষের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত থাকে না? এর উত্তর খুবই স্পষ্ট, কারণ যারাই ক্ষমতায় আসেন তারা প্রত্যেকেই নির্বাচনী নামে টাকার খেলা খেলেন। সেই টাকা কোথায় থেকে আসে কারা দেয়। সেই কালো টাকা আর পেশিশক্তির দাপট নিরসনে আজ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। বাজার সিন্ডিকেট জনগণের পকেট কেটে নিয়ে যাচ্ছে এ দেশের পুঁজিপতিদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই। জোরালো কোনো কৃষকের আন্দোলন নেই আর নেই কোনো শ্রমিকের আন্দোলন। সবাই যেন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে শোষণের কারখানায় জ¦লছে। গরিব মানুষের মোটা চালের কেজি পৌঁছেছে ৫০ টাকায়। এ দেশে অদৃশ্য কোনো দস্যু প্রবেশ করছে কালোবাজারিতে ভরিয়ে ফেলছে। ইতিহাসে আমরা তো কখনো দেখিনি যে, খাদ্যের অভাবে এই পৃথিবীতে কখনো পণ্যের দাম বাড়িয়েছে অথচ কৃত্রিম সংকট, সরবরাহে ঘাটতি কথা বলে তেলের দাম বৃদ্ধি করা কতটা যৌক্তিক। গত সাত-আট বছর আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কম থাকলেও তখন দেশে জ¦ালানির মূল্য হ্রাস করতে আমরা দেখিনি। এত বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। সেই লাভের টাকা কোথায় গেল? কেরোসিন তেলের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় গ্রামাঞ্চলে। দাম বাড়ার ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। বাড়তি খরচ দিয়ে ফসল উৎপাদনের পর কৃষক পণ্যের দাম না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বোরো মৌসুমে ব্যাপকভাবে ডিজেল ব্যবহার হয়। খরচ বাড়ার কারণে কৃষক চাষাবাদ কমিয়ে দেবে, এতে আমাদের উৎপাদন বিঘিœত হবে। দাম বাড়ার ফলে গ্রামীণ জীবনে ব্যয় বাড়বে। মানুষের কষ্ট বাড়বে, দুর্ভোগ বাড়বে। তখন দুর্ভোগের দায়ভার রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার ভারসাম্য সাধারণ মানুষের অধিকার। টিসিবি পণ্যের সহজলভ্যতা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করে বাংলাদেশে দুর্নীতি, কালোবাজারি ও মজুতদারি শক্ত হাতে দমন করতে হবে। ডিজেল ও কেরোসিন তেলে দাম বৃদ্ধি নয়, ডিজেলে ব্যবহারকারীদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ভর্তুকি দিতে হবে। গ্রামীণ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির পাগলা ঘোড়া বাজারে আগুন ছড়িয়ে পড়বে।
দেশে ঘনঘন জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে। ক্ষতি হবে অর্থনীতির। করোনাপরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এবং জনস্বার্থে এ সময় জ¦ালানি তেলের দাম স্থিতিশীল রাখা রাষ্ট্রের একান্ত প্রয়োজন।
রাশেদুজ্জামান রাশেদ : কলাম লেখক