সীমান্ত ঘেঁষা শেরপুরের তিনটি উপজেলা বনাঞ্চল
ঘেরা। এসব পাহাড়ি এলাকায় ভারত থেকে নেমে আসা শতাধিক বন্যহাতি দীর্ঘদিন
যাবত বসবাস করে আসছে। তাই সরকার বন্যহাতির সুরক্ষায় সেখানে অভয়ারণ্য তৈরি
করে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বনাঞ্চলের ভূমি স্থানীয়রা দখলে নেয়ায় সংকুচিত হতে
থাকে বনের পরিসর। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে হাতির দল খাবারের সন্ধানে পালাক্রমে
এখন লোকালয়ে হানা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। এ কারণে পাহাড়ি অঞ্চলে এখন
হাতি আতঙ্ক বিরাজ করছে।
ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, জীবিকার আর অন্য কোনো উপায় না থাকায় বনের জমিতে
তারা চাষাবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে বনাঞ্চলে মানুষের রাজত্বে
অতিষ্ঠ হাতির দল আবারও লোকালয়ে চলে এসেছে জানিয়ে বন কর্মকর্তারা বলছেন,
ক্ষতিগ্রস্তদের বনের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে নেয়া হচ্ছে বিকল্প
কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা।
জেলা বন অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয়রা চলে গেছে বন্য হাতির
বাড়িতে। যেখানে হাতির থাকার কথা সেখানে এখন মানুষ রাজত্ব করছে। এর জন্য
হাতি আর মানুষের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। হাতি ও মানুষের এই দ্বন্দ্ব নিরসনে
এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ইতোমধ্যে বন বিভাগসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল হাতি সুরক্ষার
বিষয়ে আলোচনা করতে ভারতের বিভিন্ন সেমিনারে অংশ নিয়েছে। একই কারণে ভারতের
কর্মকর্তারাও এদেশে এসেছেন। কিন্তু লোকবলের অভাবে সেই অভিজ্ঞতা মাঠ
পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
তারা জানান, হাতির অভয়ারণ্য এলাকায় মানুষজন বনের ভিতরে বাড়ি-ঘর তৈরি
করছে। বনের গাছপালা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে, জঙ্গল পরিস্কার করে জবরদখল করে
মৌসুমভিত্তিক ফলমূল ও সবজি আবাদ করছে। এতে বন্য হাতির আবাসস্থল ধীরে ধীরে
সংকুচিত হয়ে এসেছে। এ কারণে ক্ষুদ্ধ হাতির দল লোকালয়ে এসে মানুষের বাড়ি
ঘরে বারবার হানা দিচ্ছে এবং চলতি আমন ধানের পাকা ফসল খেয়ে সাবার করে
দিয়েছে। বাদ যাচ্ছে না ফল বাগান আর সবজি ক্ষেত।
তারা জানান, স্থানীয় জনসাধারণের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ২০১৬ সালে
লোকালয়ে হাতির হামলা ঠেকাতে ঝিনাইগাতী উপজেলার তাওয়াকুচা এলাকায়
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সোলার ফ্যান্সিংয়ের
(বৈদ্যুতিক বেড়া) পাইলট প্রকল্প (পরীক্ষামূলক) বাস্তবায়ন করে। কিন্তু এসব
এলাকার মানুষ বনের ভিতর হাজার হাজার গরু চড়িয়ে সোলার ফ্যান্সিংগুলো ধ্বংস
করে ফেলে।
এলাকাবাসীর জানমাল ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা মাথায় রেখে আবারও নতুন করে
শ্রীবরদীর রাঙ্গাজান, খ্রিস্টানপাড়া ও বালিজুড়ি এলাকায় আট কিলোমিটার জুড়ে
সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নষ্ট
হয়ে যাওয়া সোলার ফ্যান্সিংগুলো মেরামতের জন্য বাজেট চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে
অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া হাতিকে বনে রাখার জন্য সরকারের সুফল প্রকল্পের আওতায় বিপুল পরিমাণ
ওষুধি, ফলমূল ও কাঠগাছ রোপণ করা হচ্ছে। এখন জনসাধারণকে বনের জ¦ালানি কাঠ
ও আগাছা কাটতে দেয়া হচ্ছে না। এর ফলে ওই এলাকা আরও গহীণ বনে পরিণত হবে।
সেখানে থাকবে ফুড ফেস্টার বাগান (তৃণ জাতীয় উদ্ভিদ), বাঁশ, কলা,
কাঁশফুলের বাগান, আমলকি, হরতকি, বহেড়া ও চাপালি জাতীয় গাছ। একসময় বনে আর
হাতির খাবারের অভাব হবে না। পাশাপাশি হাতির খাবারের সংস্থান আরও স্থায়ী
রূপ দিতে চিন্তাভাবনা চলছে।
শেরপুরের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার দেয়া তথ্য মতে, ১৯৯৫ সাল থেকে
বন্যহাতির আক্রমণে এ পর্যন্ত জেলার শ্রীবরদী, নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীতে
নারী, পুরুষ ও শিশুসহ প্রায় ৯০ জন মারা গেছে। আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি।
অন্যদিকে নানা কারণে ২৫-৩০টি বন্য হাতির মৃত্যুও হয়েছে। এ পর্যন্ত বন্য
হাতির আক্রমনে শতশত ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সহা¯্রাধিক একর জমির ফসল, সবজি ক্ষেত
ও ফল বাগান নষ্ট হয়েছে।
ঝিনাইগাতীর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হক বলেন,
সরকার সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য
আলাদা কোনো লোকবল নিয়োগ করেনি। অন্যদিকে জেলা বন বিভাগেও রয়েছে কর্মীর
অভাব। এ কারণে ওই প্রকল্পটি প্রাথমিক পর্যায়ে সফলতা বয়ে আনলেও তা ধরে
রাখা সম্ভব হয়নি।
শ্রীবরদীর বালিঝুড়ির ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, বন্য
হাতির দল অতি সম্প্রতি সোনাঝুড়ি এলাকায় হামলা চালিয়ে সবজি বাগান খেয়ে
সাবার করে দিয়েছে। এ কারণে সেখানকার মানুষ হাতির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।
লোকবল কম থাকায় হাতি-মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা এখন কষ্ট সাধ্য হয়ে
পড়েছে।
শেরপুর থেকে সদ্য বিদায়ী সহকারী বন সংরক্ষক প্রাণতোষ রায় বলেন, যারা
প্রতিনিয়ত বন থেকে জ¦ালানি কাঠ, পাথর ও বালি নিচ্ছেন তাদের এই
নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এজন্য বন এলাকার তিন
কিলোমিটারে বসবাসকারীদের খানা জরিপ করা হচ্ছে। এদের মধ্যে অতিদরিদ্র,
দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত- এই চারটি ভাগে বিভক্ত করা হচ্ছে। এরমধ্যে
কারা অতিমাত্রায় বনের উপর নির্ভরশীল তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।
প্রাণতোষ রায় বলেন, চিহ্নিত ব্যক্তিরা যেন আর বনে না যায়, সেজন্য তাদের
বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এসব ব্যক্তি যদি মুদি দোকান,
কম্পিউটার, মুরগী পালন, হাঁস পালন, আটো রিকশা বা ভ্যানগাড়ির ব্যবসা করে
জীবিকা নির্বাহ করতে চাইলে বন বিভাগের পক্ষ থেকে তাদেরকে দেয়া হবে ৪০
থেকে ৫০ হাজার টাকার পূঁজি। আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে এ সহায়তা দেয়ার কাজ
শুরু হবে। সারা দেশের বনাঞ্চল এলাকার প্রায় ৪০ হাজার পরিবার এই সুবিধা
পাবেন। এর মধ্যে শেরপুরের সীমান্ত এলাকার প্রায় ৭০০ পরিবার এ প্রকল্পে
অন্তর্ভুক্ত হবেন।