আজও গ্রামাঞ্চলের বাড়ীতে অতিথি এলে মাদুর পেতে বসতে দিয়ে আপ্যায়ণ করা হয়। তবে শহরে ধনী পরিবারেও অনেক সময় কারুকার্যশোভিত মাদুরের দেখা মেলে। তীব্র গরমে শরীরের ঘাঁম শুষে মাদুর দেহ শীতল করে। আর গ্রামের অতিথি মাদুরে শুয়ে প্রকৃতির হাওয়ার আরামদায়ক ঘুম উপভোগ করেন।হয় তো আর কয়েক বছর পর মাদুর পাওয়া দুষ্কর হবে। প্রয়োজনী উপকরণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পৃষ্টপোষকতা না থাকায় বিলুপ্তী হতে চলেছে ম্যালে দিয়ে তৈরী মাদুর।
কয়রা উপজেলার চক গোয়ালবাটী গ্রামের মাদুর বিক্রেতা দিলীপ সানা বয়স ৫০ বছর। দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর মাদুর বিকিকিনি সাথে জড়িত। প্রায় ১০/১২ বছর বয়স থেকে পিতার সাথে মাদুরের ব্যাবসা করছেন। খুলনার কয়রার অন্যতম বাজার আমাদী। এখানে সপ্তাহে ৭দিন বাজার জমজমাট থাকলেও বিশেষ করে শুক্র ও মঙ্গলবার অস্থায়ী দোকানীরা তাদের উৎপাদিত এবং আমদানীকৃত পণ্য খুচরা-পাইকারী বিক্রি করেন। মাদুর বিক্রির জন্য আমাদের স্থায়ী কোনো জায়গা নেই (উপরোক্ত কথাসহ) এমনটি জানান দিলীপ সানা। তার উপর প্লাস্টিক শিল্পের বিপ্লব। ম্যালে তৈরী মাদুর গরমে দিনে আরাম দায়ক এবং স্বাস্থ্যসম্মত। দিলীপ সানার মত কয়েক জন বিক্রেতা অভিযোগ করেন মাদুর নিয়ে বসে বিক্রি করার মত আমাদী বাজারে আমাদের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই।
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল অঞ্চলের এক প্রাচীন শিল্প এ মাদুর। প্রায় দুশ’ বছর আগে এ শিল্প গড়ে ওঠে। একসময় ম্যালে তৈরী মাদুর রফতানি হতো ইতালি, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, ভারত, পাকিস্তান, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল প্রভৃতি দেশে। আর এ থেকে আসতো প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা।তৃণজাতীয় উদ্ভিদ ম্যালে। লবাক্ত পতিত জমিতে এ ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ জন্মে। তবে অনেকে আবার বাণিজ্যিক ভাবে ম্যালে চাষ করছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাদুর শিল্পে ভাঁটা পড়ে। মাদুর শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ম্যালে একসময় পতিত জমিতে প্রচুর পাওয়া যেত। বর্তমানে ম্যালের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।লবণাক্ত পানি থেকে উপকূল অঞ্চলের ধান রক্ষা করার জন্য ১৯৬০ সালে ব্যাপক হারে ওয়াপদার বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ফলে বহু ম্যালের বাগান ধ্বংস হয়ে যায়। ম্যালে জন্মে ছোট ছোট জলাশয়ে, খাল বিলে এবং নদীর চরে। বর্তমানে যে ম্যালে পাওয়া যাচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
খুলনা জেলার চুকনগর, পাইকগাছা, সোলাদানা, গড়ুইখালী, আমাদি,হোগলা ঘুগরকাঠি, সাতক্ষীরার বড়দল, বুধহাটা এবং নয়াবেকি এসব হাট-বাজারে মাদুরের রমরমা ব্যবসা ছিল। উপকূল অঞ্চলের উন্নতমানের কারুকার্যশোভিত মাদুর তৈরি হতো, আর এত মসৃণ হতো যে তার ওপর দিয়ে সাপ চলতে পারত না। উপকূল অঞ্চলের খুলনা জেলার পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রূপসা, সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর, দেবহাটা, যশোর জেলা কেশবপুর, মনিরামপুর, বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার প্রায় ৪ লাখ মানুষ মাদুর শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত। বর্তমানে এই শিল্পে চরম দুরাবস্থা চলছে। উপকূল অঞ্চল থেকে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে মাদুর শিল্প। প্রয়োজনীয় পুঁজি ও কাঁচামালের অভাব বাজারজাতকরণের অভাবে মাদুর শিল্প দিন দিন ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টাকুর টুকুর শব্দে মুখর হয়ে থাকত মাদুর পল্লী। এখন টাকুর টুকুর শব্দ আর শোনা যায় না। নেমে এসেছে সুনসান নীরবতা। মাঝে মধ্যে কিছুসংখ্যক মাদুর বোনার কাজ চালালেও আগের মতো আর তাদের মাদুর বোনার সুর ওঠে না। ফলে এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবার গুলোর দিন চলছে দারুন দুঃখে কষ্টে। পেটের দায়ে পূর্ব পুরুষদের পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে অনেকেই। অসংখ্য মাদুর পল্লীর নির্জনতা এখন মাদুর শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো বোবাকান্নার সমর্থক। মাদুর বুনন শিল্পী অরুনা রাণী (৫৮) জানান, বর্তমানে মাদুরের কাজ করে সংসার চলে না। সুতা, ব্যয়ন, ম্যালের মূল্যদিন দিন বাড়ছে। কিন্তু উৎপাদিত মাদুরের মূল্য বাড়ছে না। আয়-ব্যয়ের সামাঞ্জস্যহীনতায় মাদুর অলাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া এই কাজ করে খুব বেশি লাভ হয় না।
মাদুর শ্রমিক নারায়নপুরের গীতা রানী (৩৫) বলেন, আমার পরিবারে ভালো উপার্জনের মতো কেউ নেই, তাই আমার স্বামীর পাশাপাশি আমাকে এই কাজ করতে হয়, কিন্তু রোজগার অতি সামান্য। মাদুর শ্রমিকদের খুব কষ্ট কমাতে এবং এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মঠবাড়ী গ্রামের পবিত্র কুমার মন্ডল। কয়রা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হরেন্দ্রনাথ সরকার বলেন, দোআঁশ ও বেলে মাটিতে ম্যালের বীজ বপন করা হলে কয়েক বছরের মধ্যে ম্যালের উৎপাদন বৃদ্ধিসহ মাদুর শিল্পের প্রসার ঘটবে। মাদুর শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ঠরা জানান সরকারী ও বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা পেলে মাদুর শিল্পকে ধরে রাখা সম্ভব হবে।