একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) দর্শন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর নক্ষত্রতুল্য কিংবদন্তী হাসান আজিজুল হকের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) বাদ জোহর রাবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে মরহুমের নামাজের জানাযা আদায় শেষে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের পশ্চিম চত্বরে তাঁকে দাফন করা হয়। এর আগে সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধায় তাঁকে অন্তিম বিদায় জানানো হয়। তার আগে সোমবার (১৫ নভেম্বর) রাত সোয়া ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় হাউসিং সোসাইটির (বিহাস) বাসভবন উজান-এ তিনি মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চিরবিদায় নেন। তিনি দীর্ঘদিন থেকে বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের দাফনের আগে পূর্ব ঘোষণা মোতাবেক তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তার কর্মস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে নেওয়া হয়। সেখানে শ্রদ্ধা জানানো শেষে দুপুর ১২টায় তার মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সেখানে আগে থেকেই পুষ্পস্তবক নিয়ে লম্বা সারি দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন অগণিত মানুষ। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের জন্য শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শুরু হয়। এ সময় সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, শিল্পী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার শ্রদ্ধা নিবেদন চলে ঘণ্টাব্যাপী।
শ্রদ্ধা পর্বে অন্যান্যের মধ্যে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুল জলিল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম, রাজশাহী-৩ (পবা ও মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, নক্ষত্রতুল্য এই কিংবদন্তী প্রফেসর হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালে ভারতের বর্ধমান জেলার যব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৮ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক এবং ১৯৬০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করেন। এরপর তিনি ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ২০০৪ সালে প্রফেসর হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে ১৯৬০ সাল থেকে তিনি কয়েকটি কলেজে শিক্ষকতা করতেন। তিনি ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ হিসেবে যোগদান করেন।
অসাধারণ সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশ-বিদেশ থেকে হাসান আজিজুল হক অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। তিনি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে একুশে পদক ও ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এর পাশাপাশি তিনি লেখক শিবির পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা অর্জন করেন। আর সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ২০১৮ সালে 'সাহিত্যরতœ' উপাধি লাভ করেন। এছাড়াও ২০১২ সালে ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ২০১৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সন্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রিতে ভূষিত করেন। তার রচিত জনপ্রিয় গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে রাঢ়বঙ্গের গল্প, সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন, নামহীন গোত্রহীন, পাতালে হাসপাতালে, আমরা অপেক্ষা করছি, রোদে যাবো ইত্যাদি। তাঁর রচিত আগুনপাখি ও শামুক যথাক্রমে প্রথম ও শেষ উপন্যাস। তার লেখা গল্পসমূহ হিন্দি, উর্দু, রাশিয়ান ও জাপানিজ ইত্যাদি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি মৃত্যুর সময় তিন মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। আর তাঁর সহধর্মিণী শামসুন নাহার ইন্তেকাল করেন ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি।
এদিকে উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য প্রফেসর গোলাম সাব্বির সাত্তার, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা রাজশাহী জেলা শাখার পক্ষে সভাপতি রফিক আলম ও সাধারণ সম্পাদক এস.এইচ.এম. তরিকুল, রাজশাহী প্রেসক্লাব ও জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে।