বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খায়রুল জাহানের ৫০ তম শাহাদাত বার্ষিকী পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে শহীদ খায়রুল স্মৃতি সংসদের পক্ষ থেকে শুক্রবার সকালে কিশোরগঞ্জ শহরের অদূরে প্যাড়াভাঙ্গা নামক স্থানে যেখানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংঘর্যে তিনি শহীদ হন সেখানে তাঁর নামে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভে পুস্পস্তবক অর্পন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শহীদ খায়রুল স্মৃতি সংসদেও অঅহবায়ক সাংবাদিক একে নাছিম খান, শহীদ খায়রুলের ভাই সাদেকুজ্জাহান তালুকদার নয়ন, ছড়াকার সামিউল হক মোল্লা,অধ্যাপক আ.গুণি, এম এ হাসান বাবুল প্রমুখ। পরে বাদ আছর শোলাকিয়া জামে মসজিদে শহীদের রুহের মাগফিরাত কামনায় মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার সকাল ১০ টায় শহীদ খায়রুল স্মৃতি সংসদে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে।
কিশোরগঞ্জের কৃতী সন্তান শহীদ খায়রুল জাহান তালুকদার বীর প্রতীক ছোটবেলা থেকে খায়রুল জাহান ছিলেন সাহসী প্রকৃতির, যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন। জেলা সদরের লতিফপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পড়াশোনা করে ১৯৬৭ সালে কিশোরগঞ্জ সরকারী বালক উচ্চবিদ্যালয় হতে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৬৯ সালে ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের অধ্যায়নরত ছিলেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে পরিক্ষা দিয়ে মনোনীত হয়েছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষন নেয়ার জন্য চিঠি আসে মার্চ মাসের ২৭ তারিখ কিন্তু তখন পাকিস্তানি আর্মিরা মেতে উঠেছে বাঙ্গালী হত্যাযজ্ঞে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অফিসার হওয়ার চেয়ে যুদ্ধ করে মাতৃভূমিকে মুক্তকরার সঠিক মনে করলেন খায়রুল জাহান। অতি আদরের বড়ছেলে যুদ্ধে যাবে বাবা আব্দুল হাই তালুকদার ও মা বেগম শামসুন্নাহারের মন সায় দিতে চায় না।
খায়রুল জাহান মুখে হাসি নিয়ে বলেন মা তোমার চারটি ছেলে কাজল, নয়ন, লেলিন তো রইলো, একটি ছেলেকে স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ কর। সেই দিনের সেই আলোচনার সময় নয়ন কাছেই ছিলেন। নয়ন ভাই দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললেন মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ভায়ের কথা যে এমন নির্মম সত্য হয়ে ফলবে তা কি তখন ভাবতে পেরেছিলাম!
কিশোরগঞ্জের মুক্তিকামী তরুণ যুবকদের সংঘটিত করে খায়রুল জাহান বাসা থেকে বের হয়ে পড়েন জুন মাসের ৭ তারিখ। ভারতের মেঘালয়ে মেজর হায়দারের অধীনে সামরিক প্রশিক্ষন নিয়ে মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ২ নং সেক্টরের গ্রুপ কমান্ডার হিসাবে পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য লড়াই করেন। নভেম্বরে চলে আসেন গ্রামের বাড়ী লতিফপুরে বেশ কয়েক জন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে অপারেশন চালাবার পরিকল্পনা করেন। ভোর বেলায় প্যারাভাঙ্গায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। সহযোদ্ধাদের নিরাপদে স’রে যাবার সুযোগ সৃষ্টির জন্য খায়রুল জাহান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাই গুলি ছুড়তে থাকেন শত্রুর উপর। সহযোদ্ধাদের অধিকাংশই অক্ষত অবস্থায় স’রে যেতে পারে। ৭-৮ জন পাক আর্মি নিহত হয় প্যারাভাংগার যুদ্ধে। শত শত পাক আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে একপর্যায়ে প্রতিপক্ষের গুলির আঘাতে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল জাহান। এ যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম ও শহীদ হয়েছিলেন। দিনটি ছিল নভেম্বরের ২৬ তারিখ
বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুলের ছোট ভাই নয়ন তখন ৮ম শ্রেণীতে পড়াশুনা করছিলেন। বড় ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পান দুপুর বেলায়। সাইকেল নিয়ে তখনি ছুটে যান বাসায় দেখেন রাজাকার ও পাক আর্মিরা বাসা ঘিরে রেখেছে। পিতা আব্দুল হাই তালুকদার তখন বাসায় ছিলেন না। রাজাকার হোসাইন তার পেন্টে লেগে থাকা শহীদ খায়রুলের রক্ত মাকে দেখিয়ে উল্লাস করে, চিৎকার করে গালি গালাজ করে।
ব্যাথিত অতীত যেন বর্তমান হয়ে দেখা দেয়। ৫০ বছর আগে ভাইকে হারানোর কথা বলতে গিয়ে নয়ন নিশ্চুপ হয়ে পড়েন। তিনি ঘাতকদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের দেওয়া রায় দ্রূত কার্যকর দেখতে চান। তার স্মৃতি রক্ষার্থে প্যারাভাঙ্গা গ্রামের সেই রণভূমিতে একটি স্মৃতি স্তম্ভ রয়েছে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে দেশের প্রথম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ ফলকটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ময়মনসিংহ কারিগরি ছাত্রাবাসের নাম রাখা হয়েছে ‘শহীদ খায়রুল ছাত্রাবাস’। কিন্তু নিজ জেলায় তাঁর নামে গড়ে ওঠেনি কোন স্মৃতি।