বিশেষ সুবিধা বাতিল হওয়ায় এবার কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে তেমন সাড়া মেলেনি। অথচ গত অর্থবছর (২০২০-২১) কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের বিশেষ সুবিধা অনেকেই লুফে নিয়েছিল। পাশাপাশি অপ্রদর্শিত জমি-ফ্ল্যাট এবং লুকানো নগদ অর্থ ও ব্যাংক আমানত রিটার্নে প্রদর্শনেরও হিড়িক পড়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) কালোটাকা বিনিয়োগের সাড়া নেই। হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ, জমি-ফ্ল্যাট, নগদ অর্থ ও ব্যাংক আমানত রিটার্নে প্রদর্শন করেছে। কারণ চলতি অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) শেয়ারবাজারসহ কয়েকটি খাতে করহার বাড়িয়ে নীতিমালা কিছুটা কঠোর করেছে। যার ফলে কালোটাকা সাদা করার প্রবণতা কমে গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত শেয়ারবাজারে মাত্র ৬ জন কালো টাকা বিনিয়োগ করেছে। অথচ গত অর্থবছর বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় ২৮৬ জন কালোটাকা বিনিয়োগ করেছিল। গতবার কালোটাকা বিনিয়োগের বিপরীতে ৪০ কোটি টাকারও বেশি কর আদায় হলেও এবার কালোটাকা বিনিয়োগের বিপরীতে কর আদায় হয়েছে মাত্র ৮১ লাখ টাকা। আর এবারের কালোটাকা বিনিয়োগকারীদের ৬জনের মধ্যে ৩ জনই ময়মনসিংহ কর অঞ্চলের করদাতা। যদিও গতবার বিশেষ সুবিধা থাকার পরও ময়মনসিংহ থেকে একজনও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেনি।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে লুকানো নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র রিটার্নে প্রদর্শনের আগ্রহে ব্যাপক ভাটা পড়েছে। গত অর্থবছরে যেখানে ৭ হাজার ৫৫ জন করদাতা লুকানো নগদ অর্থ, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র রিটার্নে প্রদর্শন করেছিল, চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত সেখানে মাত্র ৭০ জন তা করেছেন। ফলে এনবিআরের কর আদায়ও ব্যাপক হারে কমেছে। গত অর্থবছর এক হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা আদায় হলেও এবার তা সর্বসাকুল্যে সাড়ে ৬ কোটি টাকায় ঠেকেছে। আর অপ্রদর্শিত জমি-ফ্ল্যাট প্রদর্শনের অবস্থা আরো ভয়াবহ। অক্টোবর পর্যন্ত জমি প্রদর্শন করেছে মাত্র ৪৯ জন। আর ফ্ল্যাট প্রদর্শন করেছে ১৮৪ জন। অথচ গতবার জমি প্রদর্শন করেছিল এক হাজার ৬৪৫ জন এবং ফ্ল্যাট প্রদর্শন করেছিলেন ২ হাজার ৮৭৩ জন। সবচেয়ে বেশি জমি-ফ্ল্যাট প্রদর্শন করেছে গাজীপুরের করদাতারা। গত অর্থবছর কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে এনবিআর বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল। যেখানে একজন করদাতাকে বিনা প্রশ্নে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। চলতি অর্থবছরে এনবিআর আইনটি পরিবর্তন করে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ করের পাশাপাশি ৫ শতাংশ জরিমানা আরোপ করা হয়। অর্থাৎ শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগ করতে চাইলে ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কর পরিশোধ করতে হবে। এতো বিশাল কর ব্যবধান কালোটাকা বিনিয়োগে প্রভাব ফেলেছে।
সূত্র আরো জানায়, চলতি অর্থবছর লুকানো নগদ অর্থ, সব ধরনের ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র রিটার্নে প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও কর বাড়িয়েছে এনবিআর। গতবার লুকানো অর্থ রিটার্নে প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর দিলেই চললেও এবার তা বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। অবশ্য চলতি অর্থবছরে উৎপাদনশীল খাতে কালোটাকা বিনিয়োগের বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। আগামী ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের যে কোনো জায়গায় ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকায় শিল্প-কারখানা করা যাবে। ওই পদ্ধতিতে টাকা সাদা বা বিনিয়োগ করলে দুদক বা অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করবে না। আর ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকেই ১০ শতাংশ কর দিয়ে (১৯ডিডি) শিল্পে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তবে তা শুধু হাইটেক পার্ক বা অর্থনৈতিক অঞ্চলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ওই সুবিধার ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত থাকবে।
এদিকে স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবেই কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। মূলত কালোটাকাকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে ওই সুযোগ দেয়া হয়। ১৯৭১-৭৫ সাল পর্যন্ত ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়। ওই সময়ে সরকার তা থেকে মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়। পরবর্তীকালে ওই সুবিধা বহাল থাকায় প্রতিবছরই কালোটাকা সাদা করার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ’৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত ৫০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা সাদা করা হয় আর সরকার আয়কর পায় ৮১ লাখ টাকা। আর ’৮১-৯০ পর্যন্ত ৪৫ কোটি টাকা সাদা হয় আর সরকার আয়কর পায় ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ’৯১-৯৬ পর্যন্ত ১৫০ কোটি টাকা সাদা হয়, সরকারের আয়কর আদায় হয় ১৫ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছিল। তারপর গত অর্থবছরেই সর্বোচ্চসংখ্যক করদাতা কালোটাকা সাদা করার সুবিধা নেয়া হয়।
অন্যদিকে এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চেয়ারম্যান ইউনুসূর রহমান জানান, কর বেশি থাকলে কেউ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী না হওয়ার বিষয়টি বাজেটের আগেই এনবিআরকে অবহিত করা হয়েছিল। এখন তাই হয়েছে। গতবারের মতো সুযোগ দেয়া হলে শেয়ারবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান জানান, বিনিয়োগ কমে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক। নিয়মিত আয়করের অতিরিক্ত জরিমানা দিয়ে কেউ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আসবে না। গতবার বিশেষ সুযোগ দেয়ায় বিনিয়োগ বেড়েছিল। এবার সুযোগ বন্ধ করে দেয়ায় কালোটাকার অপব্যবহারের সম্ভাবনা তৈরি হবে।