দেশের শিল্পখাতে দিন দিন গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। সামনের দিনগুলোয় ওই চাহিদা আরো বাড়বে। কিন্তু চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরবরাহ বাড়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ প্রাকৃতিক গ্যাসের নতুন মজুদ ও উত্তোলনযোগ্য ক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজে খুব একটা গতি নেই। এমন অবস্থায় জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামীতে চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান ক্রমেই বাড়বে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনও (বিইআরসি) একই আশঙ্কা করছে। বিইআরসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি ৫৫০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ওই সময়ে গ্যাসের মোট চাহিদা পূরণে আমদানিনির্ভরতা বেড়ে ৮৫ শতাংশও ছাড়িয়ে যেতে পারে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের মোট ব্যবহৃত জ্বালানির প্রায় অর্ধেকই প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু আগামীতে গ্যাস সঙ্কট বেড়ে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হলে তা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্যই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বর্তমানে দেশে যে হারে গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে তাতে ২০৩০ সাল নাগাদ জ্বালানি পণ্যটির অভ্যন্তরীণ মজুদ ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে। গত অর্থবছরেও (২০২০-২১) দেশে দৈনিক চাহিদার বিপরীতে স্থানীয় সরবরাহে ১৮৮ কোটি ঘনফুট ঘাটতি ছিল। ২০২৫ সাল নাগাদ তা বেড়ে ৩৯০ কোটি ঘনফুট হবে। আর ২০৩০ সালে ওই ঘাটতি আরো বেড়ে ৫৫৮ কোটি ঘনফুটে দাঁড়াবে।
সূত্র জানায়, গ্যাসের সরবরাহ সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার বর্তমানে এলএনজি আমদানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্য পরিস্থিতি ইতিমধ্যে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। কারণ গ্যাসের ওপর নির্ভর করেই দেশের শিল্প খাতের অনেকটা সম্প্রসারণ ঘটছে। কিন্তু ওই জ্বালানি পণ্যটির টেকসই সরবরাহ নিশ্চিত না করা গেলে সামনের দিনগুলোয় এমন ধরনের বিড়ম্বনা আরো বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। এমন অবস্থায় দেশেই গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলন কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি লাভজনক আমদানির পথও নিশ্চিত করা জরুরি। গত অর্থবছরে দেশে গ্যাসের দৈনিক গড় চাহিদা ছিল ৪৩০ কোটি ঘনফুট। তার মধ্যে স্থানীয় উত্তোলন ও আমদানীকৃত এলএনজি মিলিয়ে সরবরাহ হয়েছে ৩০১ কোটি ঘনফুট। ওই হিসাবে চাহিদার বিপরীতে দৈনিক সরবরাহের ঘাটতি ছিল প্রায় ১৩০ কোটি ঘনফুট। আর আমদানীকৃত এলএনজির সরবরাহ বাদ দিলে শুধু স্থানীয় সরবরাহ বিবেচনায় নিয়ে গত অর্থবছরে গ্যাসের দৈনিক সরবরাহে ঘাটতি ছিল প্রায় ১৮৮ কোটি ঘনফুট।
সূত্র আরো জানায়, এখন পর্যন্ত দেশে মোট ২৮ দশমিক ৩০ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। তার মধ্যে ১৮ দশমিক ৭০ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। গত অর্থবছরে প্রায় ১ টিসিএফ (শূন্য দশমিক ৮৯ টিসিএফ) গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। বর্তমানে মজুদ আছে ৯ দশমিক ৬০ টিসিএফ গ্যাস। তার বাইরে ১ হাজার সরবরাহ সক্ষমতাসম্পন্ন দুটি এফএসআরইউ রয়েছে। বর্তমানে তা দিয়ে দৈনিক ৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে ওই দুটি ইউনিট দিয়ে দশমিক ২১৬ টিসিএফ এলএনজি জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৩টি গ্যাস কোম্পানি এবং উৎপাদন বণ্টন চুক্তির আওতায় দুটি বিদেশী কোম্পানি গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে যাওয়ায় দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে প্রায়ই গ্যাস সংকট তৈরি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় পর্যায়ে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের বাইরে গিয়ে আমদানিনির্ভরতার সহজ সমাধান দেশের জ্বালানি খাতকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
এদিকে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান না করার কারণ হিসেবে প্রায়ই বলা হয় তাদের আকৃষ্ট করার মতো প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত জ্বালানি বিভাগের কাছে নেই। সেজন্য মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে প্রয়োজন। কিন্তু যে পরিমাণ তথ্য জ্বালানি বিভাগের কাছে আছে সেটুকু উন্মুক্ত করে দিলেই তা দিয়েই বিদেশী কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করা সম্ভব। মূলত বছরের পর বছর মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের কারণ দেখিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম বন্ধ রাখা হচ্ছে। সরকার স্থলভাগের পাশাপাশি সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের জন্য ২০১৫ সালে দরপত্র আহ্বান করে। মূলত সাগরে জ্বালানি তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র কেনার আগে সাধারণত বিদেশী কোম্পানিগুলো দ্বিতীয় মাত্রার ভূকম্পন জরিপের তথ্য চায়। সেজন্য দরপত্র আহ্বানের আগে একটি মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের প্রয়োজন হয়। তাতে মূলত সম্ভাব্য মজুদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা হয়। ওই বিশ্লেষণে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতেই বিনিয়োগকারীরা কূপ খননের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এ নিয়ে ২০১৬ সালে আরো একবার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। তবে তারপর আরো ৬ বছর অতিবাহিত হলেও ওই উদ্যোগ আর এগোয়নি। তাছাড়া দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনের পাশাপাশি গ্যাস আমদানি করতে পটুয়াখালীর পায়রায় ১০০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। তাছাড়া এলএনজি আমদানিতে কয়েক মাস আগে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমঝোতাও (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। তবে কাতার ও ওমানের বাইরে কোনো দেশ এখন পর্যন্ত আমদানির ওই দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারেনি। তাছাড়া গ্যাস আমদানিতে সরকারের আরো নানামুখী উদ্যোগ রয়েছে। তবে সেগুলো এখনো পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে।
অন্যদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে গ্যাসের মজুদ ক্রমান্বয়ে ফুরিয়ে যাবে তা আগেই প্রক্ষেপণ করা ছিল। তাতে কী পরিমাণ গ্যাস কমে যাবে তারও উল্লেখ আছে। কিন্তু তার বিপরীতে সংকটটা কীভাবে সামাল দেয়া হবে তা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। গত এক বছরে পেট্রোবাংলার আওতাধীন কোম্পানিগুলোর গ্যাস উৎপাদন কমেছে অন্তত ৫০ কোটি ঘনফুট। আর বহু আগ থেকেই দেশীয় গ্যাসকূপগুলোর সক্ষমতা কমছে। তা বাড়ানোর জন্য কম্প্রেসার বসানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ওই উদ্যোগ যথাসময়ে নেয়া হয়নি। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল-গ্যাসের মূল্যে অস্থিরতা চলছে। আগামীতে কী হবে তাও বলা মুশকিল। স্থায়ী সমাধানে যেতে হলে দেশীয় অনুসন্ধান-উত্তোলনের পাশাপাশি সরবরাহের সুষ্ঠু একটা চ্যানেল তৈরি করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান জানান, গ্যাসের চাহিদা পূরণে জ্বালানি বিভাগ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ওই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে এলএনজি আমদানিতে চুক্তি করা হয়েছে। দেশের গভীর সমুদ্র এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। ভারতীয় একটি কোম্পানি দুটি সমুদ্র ব্লকে কাজ করছে। তাদের তথ্য শিগগিরই পাওয়া যাবে। তার বাইরে স্থলভাগে বাপেক্সের অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তাছাড়া গ্যাস আমদানির জন্যও নতুন করে এফএসআরইউ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।