সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের দেশে বহু বছর ধরেই অপ্রতিরোধ্য। নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরাও রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে গাড়িতে হাফ ভাড়া এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। এর আগে বিইউপি’র (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরি জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় বেপরোয়া গতির গাড়ির ধাক্কায় নিহত হয়। গত সোমবার বাস চাপায় এক শিক্ষার্থী মারা গেছে। নাম মাইনুদ্দীন ইসলাম দুর্জয়। নিহত শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। তারও আগে ২৪ নভেম্বর রাজধানীর গুলিস্তানে দক্ষিণ সিটির ময়লার গাড়িতে ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান মারা যায়। তার পরদিন ময়লার গাড়ির ধাক্কায় আরও এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এ দুই ঘটনার পর থেকেই সড়কে আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা। আবরার আহমেদের মৃত্যুর পর এভাবেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। সড়কে মৃত্যুর কয়েকটি গুরুতর কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো প্রতিযোগীতা। চালকের কাছে নিয়ম মেনে চলার চেয়ে প্রতিযোগীতা করে আগে যাওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাতে কারও প্রাণ গেলেও তার কিছু যায় আসে না। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই রাস্তায় নেমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে নিয়ম মেনে চলতে হয়। তা নিয়ে দেশের কর্তাব্যক্তিরা প্রশংসা করেছিল। কিন্তু তাদের সেই সময়কার দাবীগুলোর কয়টি পূরণ হয়েছে? এর সাথে রয়েছে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের আন্দোলন। শিক্ষার্থী বিষয়টি বিবেচনায় এর দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত।
প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে যেভাবে প্রতিদিন পাখির মত মানুষ সড়কে মারা যায় সেরকম কোন পরিস্থিতি হয়না। উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাইভেট গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পরা। বাসও দুর্ঘটনার কবলে পরে তবে তার সংখ্যা অনেক অনেক কম। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানে বাস, ট্রাক, নসিমন এসব। এর আগে বাসের চিপায় শিক্ষার্থীর হাতের দৃশ্যটি আজও চোখে ভাসে। সত্যি বাসগুলোর বড় তাড়া! আগে গেলেই যাত্রী বেশি। আর বেশি যাত্রী মানে লাভ বেশি। সব কিছুতেই হিসেব। কেবল মানুষের হাত, পা বা জীবনের কোন হিসেব থাকে না। আবার কোথাও বাসের ধাক্কায় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। যাতে সে সুস্থ হয়ে বেঁচে তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপে না যায়! যেখানে চালকের অসাবধানতা, অদক্ষতা, বিপদজনক ওভারটেকিং এসব দায়ী থাকে। শুধু দুর্ঘটনা বলে দিনের পর দিন এসব মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। মানুষের জীবন এত সস্তা যে অবহেলায় চাকার নিচে পিষ্ট হলেও তাকে দুর্ঘটনা বলা হচ্ছে। আমাদের দেশে যারা মহাসড়কে বা অন্যান্য সড়কে যানবাহন চালায় তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত। গাড়ি চালানোর সঠিক সাইড, গতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়গুলো জানে না বললেই চলে। আবার জানলেও আইনের ফাঁক ফোকর খুঁজে তার মার প্যাঁচে ঠিক নিজেকে বের করে নেয়। ফলে এত এত দুর্ঘটনা ঘটলেও শাস্তির খবর আসে হাতে গোণা। অথচ এর চালকের ভুলেই কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার হার বেশি থাকে। কিন্তু শাস্তির ক্ষেত্রে তা লঘু অপরাধে পরিণত হয়। আমাদের দেশে দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই! মানুষের জীবনের মূল্য কোথায়!
দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর সাময়িকভাবে বোধ জাগ্রত হয়। মনে হয় এটা হওয়া উচিত ছিল, ওটা করা দরকার ছিল। শেষপর্যন্ত কিছুই হচ্ছে না। শুধু দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। আবরাররা আর ফেরে না। কোনোদিন ফিরবে না। আবরারদের মতো অসংখ্য মানুষের রক্তের দাগ থাকে রাস্তায়। আমার সন্তান রাস্তায় নিরাপদ না অভিভাবক এ কথা ভেবে দুশ্চিন্তায় থাকেন। মনে হয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না তো? সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কিন্তু আমরা প্রায় সবাই জানি। বিভিন্ন সময়ে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে পেছনের কারণগুলো বের হয়ে এসেছে। সড়ক মহাসড়কে ক্রটি ও বিপদজনক মোড়গুলো কমিয়ে আনা, লাইসেন্সবিহীন সহকারীদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেওয়া থেকে বিরত থাকা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সচেতনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা, আইনের আধুনিকায়ন করা ইত্যাদি অনেক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যেতে পারে। তবে সব কথার বড় কথা নিজেকে তৈরি করা। যাত্রী হিসেবে আমি যেমন রাস্তায় চলাচলের আইন মানতে বাধ্য ঠিক তেমনি একজন চালক হিসেবেও যেন কেউ আইন সঠিকভাবে মেনে চলে। উন্নত বিশ্ব যদি সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারে তাহলে আমরা পারবো না কেন? দুর্ঘটনা ঘটার পর কার দোষ ছিল কার দোষ ছিল না এসব না ভেবে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেটা চিন্তা করাই ভাল। কারণ দুর্ঘটনা ঘটার পর সেই দায় আর কেউ নিতে চায় না। চালকদের প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী। নতুন আইন দুর্ঘটনা রোধে কতটা সুফল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো আইনের পাশাপাশি নিজেদের আইন মেনে চলার অভ্যাসটাও করতে হবে। সড়কে মড়ক রোধ করতে হবে। এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে না পারলে তা আরও বহু প্রাণ কেড়ে নেবে এবং বিপুল আর্থিক ক্ষতির কারণ হবে।
শিক্ষার্থীরা ক্লাসে থাকবে। ক্লাসে ফিরবে। লেখপড়া করবে। তাদের রাস্তায় নামতে হয় কেন? এরাই আমাদের দেশের ভবিষ্যত। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চাবি তাদের হাতেই। প্রতিদিন পাবলিক বাসে যাওয়া আসা করে অত্যন্ত কষ্ট করেই। আবরারের মৃত্যুর পর শুরু হওয়া আন্দোলন সড়ক নিরাপদ করতে পারবে কি না তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। আমরা আর কোনো দুর্জয়,নাঈম বা আবরারের অপমৃত্যু চাই না। আমরা চাই না কারো রক্তে রাজপথ ভিজে থাক। আমরা সত্যিকার অর্থেই একটি নিরাপদ সড়ক চাই। সেই সাথে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধান হোক এটাই প্রত্যাশা।
শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক