বাংলাদেশে সড়ক-আকাশ-রেল ও নৌপথ দুর্ঘটনা-দুর্নীতিরোধে সচেতনতা তৈরির জন্য নিবেদিত দেশের একমাত্র স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন সেভ দ্য রোড-এর তথ্যানুযায়ী পথদুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে মৃত্যুবরণ করে ৪০ জনেরও বেশি। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-সাংবাদিক-পুলিশ- সেনাসদস্যসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি, মৃত্যুবরণ করেছে ছাত্র-সাংবাদিকসহ বেশ কয়েকজন নাগরিক। পথ দুর্ঘটনারোধে সরকারের কোন কার্যত পদক্ষেপ আমরা দেখিনি। বরং শুনেছি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ৮০% বাসের মালিক গরিব। বলেছেন, কোনভাবেই বেসরকারি পরিবহনে ‘হাফ পাশ’ দেয়া হবে না। এরই মধ্যে মহাসড়কের ক্ষতি হ্রাস, স্থায়িত্ব, সার্বিক নিরাপত্তা ও যানবাহন চলাচলের গতিশীলতা নিশ্চিত করতে ওভারলোড নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিল বাস করেছে জাতীয় সংসদ সদস্যগণ। বলা হচ্ছে- এই বিলে প্রতিবন্ধী, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের মহাসড়কে নির্দিষ্ট স্থান ও নিরাপদে ব্যবহারের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও আছে।
ফুটপাতগুলো কোনভাবেই হাঁটার উপযোগি নেই, উপযোগি নেই সাধারণ মানুষের রাস্তা পারাপারের। তবু বলছে- দেশে উন্নয়নের চাকা চলছে। যে উন্নয়নের চাকায় পিষ্ট হয়ে জন্মদিন মৃত্যুদিনে পরিণত হয়েছে স্কুল শিক্ষার্থী দুর্জয়ের; সেই উন্নয়নের রাস্তায় আর অগ্রসর হতে চায় না বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা। তারা চায় আইনের শাসন, চায় আইন বাস্তবায়ন। যে কারণে দুর্ঘটনামুক্ত পথের দাবিতে রাজপথে বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর দিন থেকে শুরু হয় এ আন্দোলন।
আমরা দেখেছি ‘রাষ্ট্রের সংস্কার চলছে’ প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ধানমন্ডি, সায়েন্স ল্যাব, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হয়েছে। দুর্ঘটনামুক্ত পথের দাবিতে তুলে ধরা ৯ দফার সঙ্গে গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ পাসের বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে। তাদের সাথে আলোচনা করে যতটুকু বুঝেছি, তাতে তাদের ৯ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- নাঈমসহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সব শিক্ষার্থীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আহত সব যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। সড়ক, নৌ ও রেলপথে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস নিশ্চিত করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। বৈধ-অবৈধ যানবাহন চালকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বৈধতার আওতায় আনতে হবে। বিআরটিএর সব কার্যক্রমে নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সারাদেশে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা স্বয়ংক্রিয় আধুনিকায়ন এবং পরিকল্পিত নগরায়ণ সুনিশ্চিত করতে হবে। গণপরিবহনে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতা বন্ধ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পরিকল্পিত বাস স্টপেজ ও পার্কিং স্পেস নির্মাণ এবং এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
ধানমন্ডি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে ছিল স্লোগান, হাতের প্ল্যাকার্ডেও লেখা ছিল দাবির কথা। এর মধ্যে রয়েছে- রাস্তা বন্ধ রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ চলছে, আবারও অগ্নিস্নান, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়, মৃত্যু কুয়া আজ সড়ক হলো, নিরাপদ সড়ক চাই, জাগো জনগণ জেগে ওঠো, সড়কে মৃত্যুর মিছিল আর কতদিন, পথ যেন না হয় মৃত্যুর পথ যেন হয় নিরাপদ, আমি নেক্সট ইত্যাদি।
সায়েন্স ল্যাব, শাহবাগ ও যাত্রাবাড়ী এলাকায়ও গতকাল বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। অবশ্য শিক্ষার্থীদের ‘হাফ পাশ’ নিয়ে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাস মালিকরা ৩০ নভেম্বর নতজানু হয়ে মেনে নিলেও এর আগে বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠকে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া চালু হলে মালিকদের ক্ষতি কীভাবে পূরণ করা হবে, তা ঠিক করতে টাস্কফোর্স গঠনের দাবি জানান পরিবহন মালিক ও নেতারা। নতুন এ দাবির কারণে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারেনি বিআরটিএ। গতকাল শনিবার বনানীর বিআরটিএ কার্যালয়ে এ বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব এবং ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিক সমাধানের চেষ্টা চলছে। বৈঠকে তারা বলেছেন, ঢাকার অধিকাংশ বাস মালিক গরিব। এ কারণে হাফ ভাড়া নিলে মালিকদের যে ক্ষতি হবে, তা সরকার কীভাবে পূরণ করবে, সেই সিদ্ধান্ত আগে নিতে হবে। মালিকদের ক্ষতিপূরণ কীভাবে করা হবে, তা নির্ধারণ করতে একটি টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন পরিবহন নেতারা। তিনি দাবি করেন, হাফ ভাড়ার দাবিতে ভাঙচুর ও শ্রমিকদের মারধর করা হচ্ছে।
তবে বাস্তবতা হলো- রাজধানীর গাবতলী থেকে মতিঝিলের দূরত্ব ১১ দশমিক ৮ কিলোমিটার। কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা হিসাবে এ পথের ভাড়া ছিল ২০ টাকা। কিন্তু নিত ২৫ টাকা। ডিজেলের দাম বাড়ায় ৪৫ পয়সা বেড়ে কিলোমিটারে বাসের ভাড়া হয়েছে দুই টাকা ১৫ পয়সা। এ হিসাবে মতিঝিল-গাবতলীর ভাড়া হবে ২৫ টাকা। কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা। বাসের ভাড়া বৃদ্ধির প্রথম দিনে সরেজমিন 'ওয়েলকাম পরিবহন'কে এ ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে। প্রথমে প্রতিবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে বাধ্য হন যাত্রীরা। ক্ষুব্ধ যাত্রীরা বললেন, আগেও বেশি ভাড়া নিত। ভাড়া বাড়ানোর পরও বেশি নিচ্ছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে রাজধানীর রামপুরা বাজারের কাছে বাসচাপায় মাইনুদ্দিন নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় সোমবার রাতে বিক্ষুব্ধ জনতা অন্তত ১২টি বাসে আগুন দিয়েছে। মৃত্যুর দিনটিই ছিলো নিহত শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন জন্মদিন। কষ্টকথাটি হলো- এই মাইনুদ্দিনের বাবা বাবা রামপুরায় একটি চায়ের দোকান পরিচালনা করেন এবং দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মাইনুদ্দিন সবার ছোট। এর আগে সম্প্রতি ঢাকায় সিটি কর্পোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের একজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর ছাত্ররা ব্যাপক বিক্ষোভ করেছিলো। রামপুরায় সহপাঠীকে ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামানোর অভিযোগে অন্তত চল্লিশটি বাস আটক করেছিলো স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে পুলিশের সহায়তায় মালিকদের সাথে আলোচনার পর বাসগুলো ছেড়ে দিয়েছিলো তারা। এসব ঘটনার রেশ না কাটতে নাকাটতেই অনাবিল পরিবহনের একটি বেপরোয়া বাসে চাপা পড়ে শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলামের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলো।
যতদূর জানতে পেরেছি- রাইদা পরিবহনের একটি বাস রামপুরা থেকে মালিবাগের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে একটি ছেলে রাইদা বাসে উঠতে চেষ্টা করে মাইনুদ্দিন। বাসে ওঠার পর কোনো কারণে সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে দেওয়া হয়। বাঁ পাশ দিয়েই বেপরোয়া গতিতে অনাবিল পরিবহনের একটি বাস আসছিল। বাসটি মাইনুদ্দিনকে চাপা দেয়। এভাবেই একের পর এক প্রাণ যাচ্ছে অদক্ষ-অযোগ্য-অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাস চালক-সহযোগিদের বেপরোয়া চলাচলের কারণে। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির জন্য সেভ দ্য রোড অবশ্য বারবার দাবি জানিয়েছে দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ-প্রশাসন; চায় দুর্নীতিমুক্ত বিটিআরএ এবং সড়ক নির্মাণ-সংস্কার ব্যবস্থাপনা। চায় লোভহীন সেবার উদাহরণ পরিবহন ব্যবস্থায়। চায় চলার পথে সচেতনতা। আশা করি সেই চাওয়া পাওয়ার কথা ভেবে বাংলাদেশকে বাঁচাতে উদ্যেগ নেবে বর্তমান সরকার। কিশোর আন্দোলনের মত কোন দুর্ঘটনামুক্ত পথ-এর ব্যবস্থা না করে অতিতের মত বন্ধ করে দেবে না শিক্ষার্থীদের এই সাহসী আন্দোলন...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি