গত ২৫ বছরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেশ ইতিবাচকভাবেই এগিয়েছে। এ সময় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও এসেছে। এই বাণিজ্য আরো বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে। তবে এজন্য বাংলাদেশকে ব্যবসা সহজীকরণসহ শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে আরো গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। অ্যামচেম সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সম্মানিত অতিথি ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক প্রত্যাহারসহ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নবায়নযোগ্য জ¦ালানি ও বাঁধ নির্মাণে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারেন।’
পোশাক রপ্তানিতে অবশ্য বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঢুকতে হচ্ছে শুল্ক পরিশোধ করেই। উচ্চ প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) পোশাক রপ্তানি আয় বেড়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪.২৯ শতাংশ। এ সময় রপ্তানি আয় হয়েছে এক হাজার ৯৭৯ কোটি ইউএস ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩.২৭ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে একক মাস হিসেবে সর্বশেষ নভেম্বর মাসে রপ্তানি আয় আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৩১.২৫ শতাংশ বেড়েছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক হাজার ৭৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে এক হাজার ৯৭৯ কোটি ডলার। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় ছিল এক হাজার ৫৯২ কোটি ৩৫ লাখ ডলার।
অন্যদিকে নভেম্বর মাসে ৩৫৭ কোটি ৫০ লাখ ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪০৪ কোটি ১৩ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় গত মাসে রপ্তানি আয় ১৩.০৪ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের নভেম্বরে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৩০৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলার।
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে হয়েছে ৪৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয় ৩৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের পণ্য। এ হিসেবে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে ২৭ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এদিকে পোশাক এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বাড়লেও কমেছে বাংলাদেশের সোনালি আঁশখ্যাত পাট ও পাটজাত পণ্যের। এ পণ্যের রফতানি চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বরে ছিল ৪৫ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয় ৫৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের। এ হিসেবে পণ্যটি রফতানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে বা কমেছে ১৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসে সরকার বিজেএমসির আওতাধীন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলে উৎপাদন বন্ধ করে ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে অবসরে পাঠায়। এই পাটকলগুলোতে উৎপাদিত চট, বস্তা, থলে বিদেশে রফতানি হতো।
এ বিষয়ে বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাষ্য, এখন শুধু বস্তা, চট ও থলে নয়, পাটসুতাসহ পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাট পণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। এই সুযোগটি যদি আমরা নিতে পারি তাহলে আমাদের এ খাতের রফতানি অনেক বাড়বে; এই মহামারীর বছরেই আমরা আমাদের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হব।
রফতানি খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে তৈরি পণ্যগুলো রফতানির প্রধান গন্তব্য পশ্চিমা দেশগুলো। কভিড মহামারীর অভিঘাত কাটিয়ে দেশগুলোর বাজার চাঙ্গা হতে শুরু করেছিল। অনেক দিন নিষ্ক্রিয় থাকা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো সক্রিয় হওয়ার পর চাহিদার উল্লম্ফনও দেখা গিয়েছিল, যার প্রতিফলন হিসেবে মোট রফতানিতে বড় প্রবৃদ্ধি দেখতে পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে এ প্রবৃদ্ধি টেকসই হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কারণ এরইমধ্যে কভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন আঘাত হেনেছে। যার প্রভাবে পশ্চিমা বাজারগুলোর চাহিদায় ভাটার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে রফতানির বর্তমান প্রবৃদ্ধি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ নেই বলে মত প্রকাশ করেছেন তারা।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে পশ্চিমা বাজারগুলোর চাহিদা বৃদ্ধির প্রতিফলন হিসেবে বিপুল পরিমাণ ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে এসেছিল। যদিও ক্রেতারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করেছেন রফতানিকারকদের। তার পরও ক্রয়াদেশ অনুযায়ী পণ্য সরবরাহের পরিপ্রেক্ষিতে রফতানি প্রবৃদ্ধি এখনো বেশ ইতিবাচক। কিন্তু এখন কভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের কারণে রফতানির গতি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে বর্তমান প্রবৃদ্ধি কতটুকু টেকসই হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রধান পণ্য পোশাক রফতানিকারকরা বলছেন, পোশাকের বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি পেয়ে খুচরা বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ফলে বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ আসছে। যদিও আমরা অনেক রফতানি করছি। কিন্তু উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গিয়ে মুনাফা কমেছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে শিল্প ভঙ্গুরতা বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে রফতানি উল্লম্ফন টেকসই করার দিকে নজর দিতে শুরু করেছিলেন রফতানিকারকরা। গুণগত সক্ষমতা গড়ে তোলাসহ মানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিষয়েও ভাবতে শুরু করেছেন তারা। তবে কভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টের ওমিক্রনের সংক্রমণে নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন রফতানিকারকরা।
এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অধীনস্থ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র (ইপিবি) মাসভিত্তিক পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, গত নভেম্বরে রফতানি প্রবৃদ্ধি হার ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ। নভেম্বরে পণ্য রফতানি হয়েছে ৪০৪ কোটি ১৩ লাখ ডলারের। গত বছরের নভেম্বরে রফতানি হয় ৩০৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের পণ্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস শেষ হয় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দিয়েই। জুলাইয়ে রফতানির ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১১ শতাংশ। আগস্টে যা ইতিবাচক ধারায় ফেরে। ওই মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয় ১৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে রফতানি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩৭ দশমিক ৯৯, অক্টোবরে যা আরো বেড়ে হয় ৬০ শতাংশ আর নভেম্বরে প্রবৃদ্ধির হার কমে হয়েছে ৩১ দশমিক ২৫ শতাংশ।