খুলনার জেলার দিঘলিয়া উপজেলার ঐতিহাসিক পাল ও সেন বংশের স্মৃতি বিজড়িত কবি নজরুলের পদচারণা ও মরমি কবি কৃষ্ণ চন্দ্র মজুমদারের দক্ষিণ বাংলার ইতিহাসখ্যাত ¯্রােতধারা রূপালী ভৈরব তীরে সেনহাটিতে এ ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন বিদ্যাপীঠ সেনহাটী সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ বিদ্যালয়টি ১৮৮৭ সালের ৩০ জুন বাবু শ্রীনাথ রায় প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রাচীন ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী সেনহাটির দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ভৈরব নদীর কূল ঘেঁষে এক মনোরম পরিবেশে বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিপীন বিহারী সেন। প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে এ পর্যন্ত ১৭ জন পরিচালক এর নেতৃত্বে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অত্র বিদ্যালয়ে ২৭ জন শিক্ষক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৮৮৮ সালে অত্র বিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী শ্রী কুমুদ বন্ধু দাস তৎকালীন সময়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং আসাম থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। সেনহাটি এলাকা ছিল সংখ্যাধিক্য সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস। সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা ও শিক্ষকতায় তাঁদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল অনেক। যে কারণে দেশ বিভাগের পর(১৯৪৭ সাল) সেনহাটি থেকে এসব হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশ ত্যাগের হিড়িক পড়ে তখন সেনহাটি বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে ছন্দপতন ঘটে।
তদানিন্তন সময়ে অত্র জনপদে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মধ্যে, চন্দনীমহল গ্রামের হাসেম আলী মিয়া (দারোগা),সুগন্ধী গ্রামের আবদুল মজিদ মোল্লা (রাঙা মোল্লা), মুন্সি আবদুল বারী, হাজীগ্রামের আবদুল আজিজ মোড়ল সহ বেশকিছু শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব এগিয়ে এসে হাল বিদ্যালয়ের হাল ধরেন।
এখানেই শেষ নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা পরবর্তীতে কদাচিৎ বেদিক ধর্মাবলম্বী ছাড়া প্রায় সবই ভারতে স্থায়ী ভাবে চলে যাওয়ায় বিদ্যালয়টিতে প্রচন্ড শিক্ষক, ছাত্র ও অর্থ সংকটের সৃষ্টি হয়। এমনই এক ছন্দ পতন মোকাবেলায় এগিয়ে আসেন সুগন্ধী গ্রামের কৃতী সন্তান শেখ রোস্তম আলী( জমি দাতা), মুন্সি আবদুল জব্বার, মোল্লা সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক খন্দকার গোলাম মোস্তফা, ছেকমত উল্লাহ (জমি দাতা) চন্দনীমহলের এম এ জাব্বার (প্রধান শিক্ষক),গাজী আনোয়ার হোসেন, সেনহাটী গ্রামের বাবু জ্যাোতিন্দ্র নাথ বাবু, বাবু শচীন কুন্ডু, মোহাম্মদ আলী(আলী বাবু), হাজীগ্রামের মোল্লা আতিয়ার রহমান, ফরমাইশখানার শেখ আবু বক্কর সিদ্দিক, আবদুর রাজ্জাক গাজী,গাজী আবদুর রব, দেয়াড়ার শেখ সাহিদুর রহমান(এমপি) সহ বেশ কিছু শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব। বলা যায়, তাঁরা অনেকটা নতুন ভাবে স্কুল পরিচালনা ও ভলান্টারি শিক্ষক হিসেবে পাঠদান শুরু করেন।
এসময় একটি এ্যাডহক ম্যানেজিং কমিটিও গঠনের মাধ্যমে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হাল ধরে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় নিলেন তাঁরা। সুগন্ধী গ্রামের কৃতী সন্তান মোল্লা সিরাজুল ইসলাম ১৯৭৪ সালে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও ছাত্র-ছাত্রী বৃদ্ধির জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
১৯৭৭ সালে কমিটি গঠন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এলে খন্দকার গোলাম মোস্তফা(সহ-সভাপতি) সাহেব স্কুলের দায়িত্ব হাতে নেন আর এখান থেকেই নতুন করে সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে এগিয়ে চলার যাত্রা শুরু হয়। অত্র বিদ্যালয়ের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্রদের সহায়তায় গঠন করা হয় ছাত্র-ছাত্রী কল্যাণ ট্রাস্ট। দিনে দিনে ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষক ও কর্মচারীও বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তীতে ছাত্র-ছাত্রী বৃদ্ধি পাওয়ায় দুই শিফট চালু করা হয়।
২০১৭ সালে বিদ্যালয়টি সরকারিকরণ করা হয়। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ডক্টর মসিউর রহমান ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ওয়াহিদা আক্তার শীলা এবং মাঠপর্যায়ে অত্র বিদ্যালয়ের সভাপতি মোল্লা মাকসুদুল ইসলাম এর একান্ত প্রচেষ্টা, সেনহাটি তথা দিঘলিয়ার সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
বিদ্যালয়টি সরকারি হওয়ার পর ছাত্র-ছাত্রীর লেখাপড়ার মানও ভালো হয়েছে। জেএসসি ও এসএসসির ফলাফল ইতিবাচক। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকা সংখ্যা ৩৫জন,অফিস সহকারী ৪জন ও ছাত্র-ছাত্রী১২০০ জন। (প্রাতঃ বিভাগে ৬০০ জন ও দিবা বিভাগে ৬০০ জন।)। একটি একতলা,দুইটি দ্বিতল ও একটি তিন তলা ভবন রয়েছে, যার কক্ষ সংখ্যা ৩১টি। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট একটা মসজিদও আছে।
অত্র বিদ্যালয়ের শুরু থেকে স্বেচ্ছায় যাঁরা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা হলেন- (১) সরদা কান্তি দাস গুপ্ত (২)রাজ বিহারী সেন(৩)রায় বাহাদুর কুমুদ বন্ধু দাস(৪)ডাঃ দিজেন্দ্র লাল সেনগুপ্ত (৫)হাসেম আলী মিয়া(৬)মুন্সি আবদুল বারী (৭)আব্দুল আজিজ মোড়ল (৮)খন্দকার গোলাম মোস্তফা (৯)মোল্লা সিরাজুল ইসলাম (১০)মল্লিক মহিউদ্দিন (১১)শেখ নজীর আহম্মেদ(১২)গাজী আবদুল হালিম(১৩)ফারহানা নাজনীন (১৪)মোল্লা মাকসুদুল ইসলাম (১৫)হায়দার আলী মোড়ল।
এ বিদ্যালয়টিতে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন তাঁরা হলেন (১) বাবু বিপিন বিহারী সেন বকসী,(২) বাবু দূর্গনন্দ সেন, (৩) বাবু ত্রিগুণা চরণ সেন, (৪) বাবু তারিণী কান্ত সেন বকসী, (৫) বাবু গোবিন্দ চন্দ্র ভাওয়াল, (৬) বাবু কুমার সেন, (৭) বাবু ত্রিপুরা সেন বকসী, (৮) বাবু সীতেন্দ্র নাথ গুপ্ত, (৯) বাবু কালীপদ সেন,(১০) বাবু গিরিজা প্রসন্ন দাশ গুপ্ত, (১১) বাবু শ্যামাপদ সেন, (১২) বাবু নরেন্দ্রনাথ সেন(ভারপ্রাপ্ত), (১৩) বাবু অমিয় মোহন রায়, (১৪) গাজী সুলতান আলী, (১৫) আজাহারুল হক, (১৬) শরীফ আমজাদ হোসেন, (১৭) শেখ আবদুল ওহাব(ভারপ্রাপ্ত), (১৮) শেখ আবদুল জব্বার, (১৯) মোঃ দেলোয়ার হোসেন, (২০) শেখ আবদুল জব্বার, (২১) বাবু শশাঙ্ক প্রসাদ পাল, (২২) গাজী আবদুর রব এবং (২৩) এসএম ফরহাদ হোসেন।
এ ছাড়া অত্র বিদ্যালয় থেকে অনেক কৃতী শিক্ষার্থী বর্তমানে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে সততা, দক্ষতা এবং যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। এদের মধ্যে অন্যতম সাবেক সফল আমলা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ডঃ মসিউর রহমান, কৃষি মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব ওয়াহিদা আক্তার শীলা উল্লেখযোগ্য। উল্লেখ্য যে, ১৮৮৮ সালে এই বিদ্যালয়ের ছাত্র কুমুদ বন্ধু দাস কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করায় তাঁকে 'রায় বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত করা হয় এবং সেনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে স্থায়ী স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
কথা হয় এ বিদ্যালয় নিয়ে এ বিদ্যালয়েরই একজন সাবেক সভাপতি, শিক্ষানুরাগী,সামাজিক ব্যাক্তিত্ব,সুগন্ধী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নব নির্বাচিত সভাপতি মোল্লা মাকসুদুল ইসলামের সাথে।
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, একটা বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে প্রধান শিক্ষকের উপর। পাশাপাশি প্রয়োজন শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমন্মিত প্রচেষ্টা। তবেই শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিখনফল অর্জিত হবে। আর এর জন্য প্রধান শিক্ষকের উদ্যোগে সহকারী শিক্ষকদের নিয়ে শিক্ষার্থীর শিখন মান উন্নয়নে কর্ম পরিকল্পনা করতে হবে এবং গৃহীত কর্ম প্লান জবাবদিহিতার মাধ্যমে শতভাগ প্রতিপালনের চেষ্টা করতে হবে। তবেই ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার উন্মেষ ঘটবে। বিদ্যালয়টি সরকারি হয়েছে। শিক্ষকদের আর্থিক উন্নয়ন হয়েছে। বিদ্যালয়ের শিখনমান উন্নয়ন অবশ্যই হতে হবে। গতানুগতিক পাঠদানে শিক্ষার্থীদের মান উ্ন্নয়ন হবেনা। প্রয়োজন প্লান মাফিক পাঠ। পাশাপাশি থাকতে হবে কারো না কারো সুপারভিশন।