সারা দেশের মধ্যেই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় আগাম টমেটো চাষের জন্য বিখ্যাত। চাহিদার ওপর বিবেচনা করেই এ উপজেলার কৃষকরা আগাম চাষ করেন। আর এ উপজেলায় টমেটো চাষ করে কৃষকরা লাভবান হওয়ায় চলতি মৌসুমে টমেটোর আবাদ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। আবার চলতি মৌসুমে টমেটোর ফলনও হয়েছে বাম্পার। তাই করোনাসহ বিভিন্ন প্রতিকুলতা কাটিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে পূর্বের ন্যয় চলতি মৌসুমে ৫শ’ কোটি টাকার ব্যবসাখ্যাত উঠে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর আগে টমেটো উৎপাদনে আলোচিত এখানকার চাষিরা গত কয়েক বছর ধরে নানা সংকটের মধ্যে পার করেছেন।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জনান, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় ১৯৯৪ সাল থেকে টমেটো চাষ শুরু হয়। বিপুল পরিমানে উৎপাদন করায় প্রায় দুই যুগ ধরে সারা দেশের মধ্যে সুনামখ্যাত হয়েছেন এখানকার চাষিরা। আর টমেটো চাষের মৌসুম ধরা হয় সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। তবে অনেকেই বেশি লাভের আশায় আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকেই টমেটোর আগাম চাষ শুরু করেন। তবে গোদাগাড়ী ছাড়াও রাজশাহীর পবা, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার চরাঞ্চলে আগাম টমেটোর আবাদ হয়। আবার বেশি ফলনের আশায় এ সময় কৃষকরা জমিতে বিপুল প্লাস, ভিএল-৬৪২, সাওসান-৮৩২৩, ইউএল-৭৪২, মহারাজ ও সালামত জাতের উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড জাতের টমেটোর আবাদ করেন। যার কারণে আগের চেয়ে চলতি মৌসুমে ফলন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ১৯৯৪ সাল থেকে গোদাগাড়ীতে বাণিজ্যিকভাবে টমেটো চাষ শুরু হলে কৃষকরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়। এ অঞ্চলে প্রায় ৩৬ জাতের টমেটোর আবাদ হয়ে থাকে। তবে এর মধ্যে ৫ থেকে ৬ জাতের হাইব্রিড টমেটোর আবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। দেশি ৫টি জাতের টমেটো থাকলে এগুলোর তেমন আবাদ নেই বললেই চলে। এছাড়াও অন্য ফসল চাষের পরিবর্তে টমেটো চাষের দিকে ঝুঁকেছেন গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষকরা। প্রতি বিঘা জমিতে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা খরচ করে আয় হয় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর ভালো লাভের আশায় চাষিরা প্রতি বছরই সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী প্রায় ৬ মাস টমেটো নিয়েই ব্যস্ত থাকে। টমেটো মৌসুমে প্রতিদিনই শত শত ট্রাকযোগে এখানকার সুস্বাদু টমেটো যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থ বছরে রবি মৌসুমে রাজশাহীতে টমেটোর মোট আবাদ ছিল ৩ হাজার ৬৬০ হেক্টর। গড় ফলন ছিল ২২.৬ মেট্রিকটন। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৬ মেট্রিকটন এবং অর্জন হয়েছে প্রায় সমপরিমাণ। মোট উৎপাদন হয়েছে ৮২ হাজার ৬২১ মেট্রিকটন। তবে চলতি অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৬ হেক্টর। কিন্তু মৌসুমের শুরুতেই এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৩৭.২৩ হেক্টর হয়েছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার হেক্টর জমিতে টমেটোর আবাদ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলে ধারণা করছে কৃষি সম্প্রসারণ কর্তৃপক্ষ।
এর কারণ হিসেবে বলছে, এ বছর চরাঞ্চল, বাড়ির আঙিনা ও সাথি ফসল হিসেবেও টমেটোর চাষ বহুগুণে বেড়েছে। চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত টমেটো উৎপাদন হয়েছে প্রায় সাড়ে ৭৭ হাজার মেট্রিকটন। অথচ গত বছর মোট উৎপাদন ছিল সাড়ে ৮৬ হাজার মেট্রিকটন। আর রাজশাহীর ৯টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে টমেটোর চাষাবাদ হয় গোদাগাড়ী, পবা ও বাগমারা উপজেলায়। এসব অঞ্চলে তিনভাগের দুই ভাগের বেশি টমেটো উৎপাদন হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
স্থানীয়ভাবে কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলে টমেটো বেচা-কেনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার লেনদেন ছাড়িয়ে যায়। প্রতি বিঘায় ৬০ থেকে ৭০ মণ টমেটো উৎপাদন হয়। আর রাজশাহীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টমেটো উৎপাদন হয় গোড়াগাড়ী উপজেলায়।
গোদাগাড়ীর মাটিকাটা গ্রামের টমেটো চাষি হাবিবুর রহমান বলেন, ১৫ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছি। প্রথমে প্রায় ২০ মণ টমেটো উঠেছে। প্রতি মণ (কাঁচা) টমেটো বিক্রি হয়েছে ১৮শ’ থেকে ২২শ’ টাকায়। দিন যত যাবে, ততবেশি টমেটো উঠবে। প্রথমদিকে ভালোই দাম পাওয়া যায়। কিন্তু পরে দাম কমে যায়। তবে বর্তমানেও ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসার শারমিন সুলতানা জানান, টমেটো উৎপাদন মৌসুম সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধরা হয়। তবে এ অঞ্চলে টমেটোর চাষ দু’বার হয়। এরইমধ্যে কিছু টমেটো মৌসুমের শুরুতেই উঠে। বাজারে টমেটোর চাহিদা থাকায় এ সময় টমেটোর বেশি দাম পান চাষিরা।
তিনি বলেন, জাতীয় অর্থনীতিতেও গোদাগাড়ীর টমেটো অবদান রাখছে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে। প্রতি বছর এখানে টমেটো নিয়ে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কে জে এম আবদুল আউয়াল বলেন, এক কথায় টমেটো অর্থকরী ফসল। জেলায় সবচেয়ে বেশি গোদাগাড়ী, পবা ও বাগমারাতে টমেটো চাষ হয়। বাজারে চাহিদা বাড়ায় প্রতি বছরই টমেটোর চাষের পরিধি বাড়ছে। ফলন বৃদ্ধিতে কৃষকরাও আধুনিক চাষের কলাকৌশলের দিকে ঝুঁকছেন। আর তাই ফলনও বাড়ছে।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে ৩৬ জাতের টমেটোর চাষাবাদ হলেও ৪ থেকে ৫ ধরনের উচ্চ ফলনশীল টমেটোর চাষাবাদ বেশি। প্রথমদিকে বাজারে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হয়েছে প্রায় ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা দরে। বতর্মানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। তবে মৌসুমের শেষে অর্থাৎ মার্চ মাসের দিকে এই টমেটোই বিক্রি হবে ৫০ থেকে সর্বনিম্ন ১০ থেকে ১৫ টাকায়। অন্যদিকে ১০ থেকে ১৫ টাকা মৌসুমের শেষ সময়ের দাম হয়ে থাকে।