বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ ভারত থেকে বাংলাদেশেও আঘাত হানতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের ওড়িশা ও অন্ধ্র প্রদেশের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলেও, গতিপথ পরিবর্তন করে সেটি বাংলাদেশের দিকে আসে কিনা, সেজন্য পর্যবেক্ষণ করছেন বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদরা।
ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে রোববার রাত থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে টানা বৃষ্টি হয়েছে। খুলনার কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙে দুটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফসলের মাঠে পানি জমেছে। এতে ধান, আলু, লবণসহ রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দিনভর টানা বৃষ্টিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টিপাত তুলনামূলক কম হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলেই কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি আবার কখনো মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে পানি জমে যাওয়ায় যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে সকালে অফিসগামী মানুষকে পড়তে হয় চরম ভোগান্তিতে। এ ছাড়া এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষাকেন্দ্রে যেতেও বেগ পেতে হয়। অনেকেই ভেজা কাপড়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢোকে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ সোমবার সন্ধ্যায় লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। মঙ্গলবার এটি আরো দুর্বল হয়ে হয়ে যেতে পারে। ফলে খুব বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। উপকূলীয় এলাকাসহ কিছু এলাকায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি থাকতে পারে। তবে কাল বুধবার থেকে সারা দেশের পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
জাওয়াদের প্রভাবে রাজধানীতেও সোমবার দিনভর বৃষ্টি হয়েছে। এতে রাজধানীর গ্রিন রোড, ধানমন্ডি, বাড্ডা, রামপুরা, হাতিরঝিল, নাবিস্কোসহ বিভিন্ন রাস্তায় পানি জমে যায়। সেই সঙ্গে রিকশাও ছিল কম। এ কারণে স্কুলে ও কর্মস্থলে যেতে রাজধানীবাসীকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সোমবার সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে যশোরে, ১৬৩ মিলিমিটার। ঢাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ১৩২ মিলিমিটার।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি দুর্বল হয়ে একই এলাকায় নিম্নচাপ আকারে অবস্থান করছে। এটি আরও উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর ও ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে পারে।
ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সাগর উত্তাল থাকায় সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদসৃষ্ট প্রবল বর্ষণে ক্ষতির শিকার হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার আমন ধান। এর মধ্যে যশোর অঞ্চলের ছয় জেলার ৯৪ হাজার ৫৩৮ হেক্টর ও বরিশাল অঞ্চলের চার জেলায় ৩৮ হাজার ৪২৯ হেক্টর আবাদি জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ১০ জেলায় প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৯৬৭ হেক্টর জমিতে আবাদকৃত আমন ক্ষতির শিকার হয়েছে।
দেশের জেলাগুলোকে কয়েকটি কৃষি অঞ্চলে বিভক্ত করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এর মধ্যে যশোর ও বরিশাল অঞ্চল অন্যতম। প্রবল বর্ষণে যশোর অঞ্চলে আমনের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলো হলো যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা। বরিশাল অঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ও পটুয়াখালী।
ঘূর্ণিঝড়সৃষ্ট অকালবর্ষণে আমনের চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব শিগগিরই নির্ধারণ করা হবে বলে ডিএই সূত্রে জানা গিয়েছে। চলতি বছর সারা দেশে আমন মৌসুমের ধান-চাল উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য হাতে নিয়েছিল ডিএই। বর্তমান পরিস্থিতিতে সে লক্ষ্য পূরণ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে, গত অর্থবছরে (২০২০-২১) দেশে ৫৬ লাখ ২৫ হাজার ৯০৭ হেক্টর জমি থেকে ১ কোটি ৪৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬৩ টন চাল উৎপাদন হয়। এ সময় আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে প্রায় আড়াই লাখ টন। আমন মৌসুমের উৎপাদনে এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় রাখার পরিকল্পনা করেছিল ডিএই। চলতি অর্থবছরে আমন মৌসুমে ৫৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি থেকে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ ৪৬ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য হাতে নিয়েছিল সংস্থাটি। এরইমধ্যে দেশের প্রায় ৫৭ লাখ ৬৩ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ করা হয়েছে। দেশে আমন মৌসুমের ধান-চালের বড় একটি অংশ আসে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে। চলমান প্রেক্ষাপটে জাওয়াদের প্রভাবে সৃষ্ট অকালবর্ষণে আমন ধানের ক্ষতির মাত্রা দ্রুততার সঙ্গে নির্ধারণ করা জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, কক্সবাজারের মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, রামু, ঈদগাঁও, টেকনাফ ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় মাঠে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই লবণের উৎপাদন শুরু হয়। তবে কুতুবদিয়া দ্বীপে মৌসুমের এক মাস আগেই লবণের উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু জাওয়াদের প্রভাবে সৃষ্ট বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন কুতুবদিয়ার লবণ চাষিরা। বৃষ্টির কারণে অন্যান্য এলাকার লবণের উৎপাদন কমপক্ষে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে গেল।
তবে যশোর ও বরিশাল কৃষি অঞ্চলে বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত জমিগুলোর পুরোপুরি নষ্ট হওয়া ধানের পরিমাণ কম বলে জানিয়েছেন ডিএইর কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মানেই সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। কোথাও কোথাও আক্রান্ত ফসল থেকে কিছুকিছু ধান উদ্ধার করা সম্ভব হবে। উত্তরের জেলাগুলোয় এবং উপকূলীয় বেশকিছু জেলায় বেশির ভাগ জমির ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। এ কারণে বৃষ্টিতে অল্প কিছু ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বীজ রাখার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হবে। খড়েরও কিছু ক্ষতি হবে। আগে থেকেই ঘোষণা দেয়া হয়েছিল কৃষকরা যাতে ধান দ্রুত কেটে ফেলেন। কিছুটা শ্রমিকস্বল্পতা ও আমন জমিতে শুকিয়ে কাটার প্রবণতার কারণে কিছু ধান ক্ষেতে রয়ে গিয়েছে। ফলে এবারের ঘূর্ণিঝড়ে আমন ধানে বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা কম। এ ছাড়া চলতি রবি মৌসুমে যেসব শস্য এরইমধ্যে লাগানো হয়েছে, বৃষ্টিতে কিছুটা হলেও সেগুলোর উপকার হবে। যা লাগানো বাকি আছে, বৃষ্টিতে জমি ভেজা থাকার কারণে তা রোপণে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। তবে মাটি সিক্ত থাকায় লাগানোর পর সেগুলোয় দ্রুত ফলন পাওয়া যাবে।
এদিকে, বৈরী আবহাওয়ায় ফিশিং জাহাজের ধাক্কায় ভোলার চরফ্যাশনে একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে গেছে বলে জানা গেছে। এতে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আট জেলে জীবিত উদ্ধার হলেও ১৩ জন নিখোঁজ রয়েছেন। সমুদ্র উত্তাল থাকায় নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে সারা দেশের নৌ যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, এই ঝড়ের নামকরণ করেছে সৌদি আরব। আরবি শব্দ জাওয়াদ অর্থ উদার, দয়ালু কিংবা দানশীল।