দলের আনুকূল্য না পেলে সংসদ সদস্য (এমপি) পদও হারাতে হবে ডা. মুরাদ হাসানকে। প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর মুরাদ হাসান এখন সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর অবস্থায় উপনীত হয়েছেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে তাঁর সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। সংবিধানের ৬৬(২) অনুসারে সংসদ সদস্য হওয়ার বা থাকার অযোগ্যতা বিষয়ে যে কারণগুলো আছে, তাতেও দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি নেই। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংসদ সদস্য পদে থাকার যোগ্যতা নিয়ে কোনো বিতর্ক উঠলে সংসদ সদস্য বিরোধ নিষ্পত্তি আইন, ১৯৮১ অনুসারে জাতীয় সংসদের স্পিকার তা নিষ্পত্তির জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠাতে পারেন।
‘ক্ষমতার গরম’ বলে একটা কথা সমাজে চালু আছে। ক্ষমতা আর চেয়ারের গরমে অনেকেই সীমা লংঘন করেন। এই সীমা লংঘন কাউকে ভালো কিছু এনে দিয়েছে কখনো শোনা যায়নি। বরং উশৃঙ্খলতা ও সীমা লংঘনকারীদের পড়তে হয়েছে ধ্বংসের মুখে। পবিত্র কোরআনে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চই আল্লাহ সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না’ (সুরা আল মায়েদা-৮৭)। দেশের মানুষ দেখলো সীমা লংঘনকরা ইসলাম বিদ্বেষী একজন বিকারগ্রস্থ প্রতিমন্ত্রীর পতন। যে চেয়ারের গরমে তিনি নারী জাতিকে অপমান করেছেন, অশ্লীল, ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলে দাম্ভিকতা দেখিয়ে স্যোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে ‘হিরো’ হতে চেয়েছিলেন; সেই প্রতিমন্ত্রীর চেয়ার তাকে ছেড়ে দিতে হলো। ক্ষমাও চাইতে হলো। তিনি তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তাকে আওয়ামী লীগের দলীয় পদ থেকেও বহিস্কার করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রীর পদ ও জামালপুর জেলার দলীয় পদ হারিয়ে তিনি এখন সংসদ সদস্য পদ হারানোর লক্ষ্যে আরেক ইসলাম বিদ্বেষী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর পথে হাঁটছেন।
এর আগে বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে মন্ত্রিপরিষদ থেকে অপসারণ বা পদত্যাগে বাধ্য করানোর পর দলের সব পদ থেকে বহিষ্কার এবং সংসদ সদস্য পদ হারানোর দৃষ্টান্ত আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। আর স্থানীয় সরকারে এমন নজির গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও রাজশাহীর কাটাখালীর সাবেক মেয়র আব্বাস আলী। তাঁরা দল থেকে বহিষ্কারের পর মেয়র পদ হারিয়েছেন।
২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রবাসী বাংলাদেশিদের এক অনুষ্ঠানে পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দা-ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ১২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। তিনি পদত্যাগ না করায় সংবিধানের ৫৮(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে তাঁর মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটানো হয়। একই দিনে তাঁকে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং দলীয় প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিল করা হয়।
নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হওয়া মুরাদ হাসান একজন বিকারগ্রস্থ মানুষ। তার লাম্পট্যের অডিও স্যোসাল মিডিয়ায় ভাসছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি মাহিয়া মাহি নামের এক নায়িকাকে ডিজিএফআই, এনএসআইন, ডিবি ও পুলিশ দিয়ে ধরে হোটেলে আনার কথা বলেন। তার নোংরা, অশ্লীল কথাবার্তা ভাইরাল হলে সর্বোত্রই ছিঁছিঁ পড়ে যায়। শুধু তাই নয়, তিনি শুক্রবার (৩ ডিসেম্বর) এক লাইভ অনুষ্ঠানে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমানের মেয়ে ব্যারিষ্টার জাইমা রহমানকে নিয়ে নোংরা মন্তব্য করেন। এমনকি তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে যে ঐদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করেন তা ক্ষমার অযোগ্য হিসেবে অবিহিত করেছেন দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষ। মুহূর্তেই তার অশালীন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যকে অসভ্য, শিষ্টাচার বহির্ভুত, নারীবিদ্বেষী, কুরুচিপূর্ণ এবং নারী সমাজের জন্য অপমানজনক বলে অভিহিত করেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতানেত্রীরা। প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে মুরাদ হাসানকে মন্ত্রিসভা থেকে বহিস্কারের দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন দাবি তোলেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে তাকে জাতির কাছে ক্ষা চাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বলেন, ‘মুরাদ হাসানের জন্ম কারো কাছে মাফ চাওয়ার জন্য হয়নি। এই বক্তব্য আমি প্রাউড ফিল করি।’ সরকারের দায়িত্বশীল একটি পদে থেকে এমন বক্তব্য কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় গণমাধ্যমকে এমনটি জানান আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলেন, এটা মুরাদ হাসানের নিজস্ব কথা, দলের নয়। কিন্তু পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মুরাদ হাসানের অশ্লীল অডিও-ভিডিও হাইকোর্টের নির্দেশে বিটিআরসি ইতোমধ্যে সরিয়ে ফেলেছে। হিরো হওয়ার বাসনায় নেট দুনিয়ায় নিজের পরিচিতি বাড়াতে গিয়ে ভিলেন হয়ে গেছেন মুরাদ হাসান। তিনি অশ্লীলতার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার নাতনির বিরুদ্ধে অশ্লীল শব্দের ব্যবহারই শুধু নয়; একজন নায়িকাকে নিয়ে তার ফোনালাপের কথোপকথন প্রচার হয়েছে। চিত্রনায়ক ইমন ও চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে সেই কথোপকথনে ডা. মুরাদকে অশালীন কথা বলতে শোনা যায়। মাহিকে হোটেল সোনারগাঁওয়ে তার ভাড়া করা রুমে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তিনি না এলে আইনশৃংখলা বাহিনীকে দিয়ে তাকে তুলে নেওয়া হবে। ওই সময় তাকে যৌন সহিংস কথাবার্তা বলতেও শোনা যায়। বর্তমানে মক্কায় অবস্থানরত মাহিয়া পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন দাবি করেছেন।
বিভিন্ন ইস্যুতে আগামহীন বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসা ডা. মুরাদের জন্য নতুন নয়। কিছুদিন আগে বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার দাবি জানিয়ে নিজ দলের মধ্যেই সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকতে পারে না’ এমন মন্তব্য করে তোপের মুখে পড়েন। নায়িকা মৌসুমির শরীর নিয়ে অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছেন। নায়ক শাকিবকে ‘তুই তো অভিনয় জানোস না। তুই তো শুধু তেলাপোকার মতো লাফাস’ বলে অপদস্থ করেন।
এদিকে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও জিয়া পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করায় সদ্য পদত্যাগ করা তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা জানান, ‘সোমবার রাতে দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্তের আলোকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় মামলা করবেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্যরা। মামলার ড্রাফট করার কাজ প্রায় শেষ। এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা পেলে আমরা সেই ড্রাফট সারাদেশে পাঠিয়ে দেব।’
বিএনপি বলছে, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং জিয়া পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে নারী সদস্যদের নিয়ে ডা. মুরাদ হাসানের অশালীন, অরুচিকর রাজনৈতিক ও সামাজিক শিষ্টাচার বিবর্জিত সম্মানহানিকর। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল পদে থেকে এই ধরনের নারী বিদ্বেষী, বর্ণবাদী, সমাজবিরোধী বক্তব্য ও সংবিধানবিরোধী এই বক্তব্যের মাধ্যমে সমগ্র নারী সমাজ এবং মানবতাকে হেয় করা হয়েছে। তাই ডা. মুরাদকে মন্ত্রিসভা ছাড়াও জাতীয় সংসদ থেকে অপসারণ ও প্রকাশ্যে জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। পরে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।