সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অব্যাহত আছে। জানা যায়, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ছয় দফা দাবি জানিয়েছেন রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। মঙ্গলবার রাজধানীর নীলক্ষেত মোড়ে এক অবরোধ কর্মসূচি থেকে দাবি মানতে তাঁরা সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে (আলটিমেটাম) দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে স্মারকলিপি দিতে গণভবনে যাবেন তাঁরা।
সূত্র জানায়,সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি হলো গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রজ্ঞাপন দিয়ে অর্ধেক ভাড়া নিশ্চিত করা ও বিআরটিসি বাস শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি করা; সব গণপরিবহনে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য অবাধ-নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিত করা ও ট্রাফিক আইনের বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজনে একে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা; সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারকে নূন্যতম এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া, আহত-ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসহ সব দায়িত্ব নেওয়া; দুর্ঘটনার জন্য দোষী চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের মালিকদের বিচারের জন্য দ্রুত বিচার আদালত স্থাপন; প্রতিটি গণপরিবহনের ভেতর দৃশ্যমান স্থানে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কপি ও গাড়ির নম্বরপ্লেট স্থাপন, সারা দেশে ট্রাফিক ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়করণ ও আধুনিকায়ন এবং পরিবহন খাতে দুর্নীতি-চাঁদাবাজি বন্ধ করে শতভাগ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও সব বেসরকারি বাস-ট্রাক-সিএনজি-ট্যাক্সির ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার।
সাত কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ছয় দফা দাবি ঘোষণা করেন আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্যসচিব ইসমাইল স¤্রাট। দাবি মানতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে তিনি বলেন, ‘এ সময়ের মধ্যে দাবি না মানা হলে আমরা ৯ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) সকালে নীলক্ষেত মোড় থেকে স্মারকলিপি নিয়ে গণভবনে যাব। আশা করছি, সরকার আমাদের দাবি মেনে নেবে। তা না হলে আমরা আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।’
গত ২৪ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হন। এ ঘটনার জেরে ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এর মধ্যেই ২৯ নভেম্বর রাতে বাসচাপায় নিহত হন রামপুরার একরামুন্নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মাইনুদ্দিন ইসলাম। এরপর থেকে রামপুরা ব্রিজের ওপর শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই কোনো না কর্মসূচি পালন করে আসছেন।
আন্দোলন শুরুর পর সড়কে শিক্ষার্থীদের নানামুখী কর্মকা- পরিচালনা করতে দেখা যায়। বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা ‘সড়ক হত্যার শিকার ব্যক্তির প্রতীকী লাশ’ নিয়ে শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা পর্যন্ত মিছিলও করেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মোমবাতি প্রজ¦ালন ও প্রতিবাদী গানের আসর করেন তারা।
শিক্ষার্থীদের এই তুমুল আন্দোলন চলাকালেও সড়কে কিন্তু মৃত্যু থেমে নেই। জানা যায়, সম্প্রতি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) এক শিক্ষার্থী ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে নোয়াখালী শহরের সোনাপুর জিরো পয়েন্টে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ঘটনাস্থল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের বুধবারের ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থী হত্যার বিচারসহ বিভিন্ন দাবিতে বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
নিহত অজয় মজুমদার (২৩) নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার মধ্য চরবাটা এলাকার বাদল চন্দ্র মজুমদারের ছেলে ও নোবিপ্রবির ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার দুপুরে সোনাপুর জিরো পয়েন্ট থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে (অটো) মান্নাননগরের দিকে যাচ্ছিলেন অজয়। এ সময় জিরো পয়েন্টেই বিপরীত দিক থেকে একটি দ্রুতগতির ট্রাক অটোরিকশাটির সামনে এসে পড়ে। চালক অটোটি দ্রুত ট্রাকের সামনে থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে অটো থেকে ছিটকে সড়কে পড়েন অজয়। এর পরই ট্রাকটির চাপায় গুরুতর আহত হন তিনি। স্থানীয় লোকজন দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। সুধারাম থানার ওসি মো. সাহেদ উদ্দিন জানান, ঘাতক ট্রাকটি তাঁরা আটক করেছেন।
সূত্র জানায়, অজয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুতে নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে বিরাজ করছে থমথমে পরিবেশ। সবাই যেন বাক্রুদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অজয়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য মো. দিদার-উল-আলম বলেন, ‘একটি সম্ভাবনাময় তরুণ মারা গেল। আমরা তার পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করব।’
জানা যায়, অজয়ের নিহত হওয়ার ঘটনা শুনে তাৎক্ষণিক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে বিকেল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত তাঁরা সোনাপুর জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে সোনাপুর-মাইজদী সড়ক অবরোধ করেন। বিকেল ৫টার দিকে শিক্ষার্থীরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে অজয় হত্যার বিচারসহ ১৫ দিনের মধ্যে সোনাপুর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সড়ক সংস্কার, নিরাপদ সড়ক, সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া কমানো, বাসের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ কয়েক দফা দাবিতে বিক্ষোভ করেন। সন্ধ্যায় সেখানে উপস্থিত হন নোয়াখালী জেলা প্রশাসক মো. খোরশেদ আলম খান, পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম, উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ মো. ফারুক উদ্দিন, প্রক্টর নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুরসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হত্যার বিচার চেয়ে স্লোগান দিতে থাকেন।
এ সময় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের সব দাবি পূরণ করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ শিক্ষার্থীরা সড়কে শান্তিপূর্ণ মিছিল করে আন্দোলন শেষ করেন।
এদিকে, রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বলদিপুকুর পাওয়ার প্লান্ট সংলগ্ন এলাকায় ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে সকালে যাত্রীবাহী নৈশ কোচের ধাক্কায় একটি অটোরিকশা দুমড়েমুচড়ে গেলে অটোর চালক রবিউল ইসলামের (৩৫) মৃত্যু হয়। তিনি তারাগঞ্জ উপজেলার বড়পুরপাড়া (ওকড়াবাড়ী) গ্রামের নুর ইসলামের ছেলে।
নীলফামারীর ডিমলার রামডাঙ্গা এলাকায় সকালে ট্রাকচাপায় বিশ্বনাথ রায় (৩৭) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। তিনি ডিমলা সদর ইউনিয়নের উত্তর তিতপাড়া গ্রামের মিমানাথ রায়ের ছেলে। ডিমলা থানার ওসি মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
এছাড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার হরিনগর রানিহাটী এলাকায় সোনামসজিদ মহাসড়কে বিকেলে ট্রাকের ধাক্কায় বাইসাইকেল আরোহী আবদুল লতিফ (৫৯) নিহত হন। তিনি এলাকার মৃত গুদর আলীর ছেলে ও রানীহাটী ডিগ্রি কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।