জলাবদ্ধতায় সাতক্ষীরা জেলার অধিকাংশ বিল ডুবে থাকায় এ বছর নবান্নের উৎসবে মেতে উঠতে পারেনি কৃষক। যেবিলগুলোতে থাকার কথা সোনালী ধানের সমারোহ সেই বিলগুলো এখনো পানিতে থৈ থৈ করছে। পনি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে মাছের ঘের করেছেন প্রভাবশালী মহল। এতে কপাল পুড়েছে গরীব চাষীদের। আমন ফসল থেকে বঞ্চিত হয়েছে হাজার হাজার কৃষক। হেমন্তের এই দিনে যেগ্রামগুলোর উঠোন ভরা থাকতো নতুন ধানের পালায়, সেই উঠোনে এবার এক আঁটি ধানও দেখা যায়নি। নবান্নের দিনে যে কৃষাণী ব্যস্ত থাকতেন ঘর গোছাতে সেই কৃষাণী এবার অলস সময় পার করছেন। কপালে তার চিন্তার ভাজ। বোরো আবাদ নিয়েও কৃষক রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। বিলের পানি যে এখনো শুকায়নি তার! রোদে শুকানো ছাড়া পানি কমার কোন পথ নেই। তবু আশা ছাড়ছে না কৃষক। আমন হারা কৃষক এবার বোরো চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জেলার ৭টি উপজেলার কৃষকেরা স্থানীয় হাট-বাজার থেকে বিভিন্ন জাতের ধানের বীজ ক্রয় করে বীজ বপনের জন্য বীজতলার জমি প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেকেই জলাবদ্ধ বিলে মাছ ধরে সংসার নির্বাহ করছেন বলে জানান তারা।
জলাবদ্ধতার কারণে শুধু সাতক্ষীরা জেলার প্রায় ৫৬ হাজার হেক্টর নিচু জমিতে বোরোর আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় একাধিক সূত্র। সাতক্ষীরায় মোট এক লক্ষ ৭৭ হাজার ৮১৪ হেক্টর জমির মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় এক লক্ষ ৩১ হাজার ৭৮৮ হেক্টর। এর মধ্যে স্থায়ী পতিত জমি প্রায় ৪৫ হাজার ১১০ হেক্টর। এর বাইরে চাষযোগ্য জমির মধ্যে মাঝারি ও নিচু জমির পরিমাণ ৪৬ হাজার ৮০৪ হেক্টর। এসব জমির বেশির ভাগ অংশ এখনো পানির নিচে। চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতার কারণে ৫৫ হাজার ৭৮৮ হেক্টর জমিতে এবার বোরো চাষ অনিশ্চিত।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফিংড়ি গ্রামের আবুল হোসেন ও মফিজুল ইসলামের অভিযোগ, খাল, বিল ও নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করার কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। রবি মৌসুমে ধান, আলু, কপি, পেঁয়াজ, বেগুন, টমেটো, গম, খেশারীসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করি। পানির কারণে এখন তা করতে পারছি না। স্থানীয় কৃষকরা জানান, জেলার সর্ববৃহৎ বিল দাঁতভাঙ্গা, মালিনি, হাজিখালি, বুড়ামারা, পালিচাঁদ, চেলারবিল, ডাইয়ের বিল, ঘুড্ডির বিল, কচুয়ার বিল, ঢেপুর বিল, লাবসার বিল, বল্লীর বিল ও পদ্মবিলসহ অর্ধশতাধিক বিল এখনও ফসল শূন্য। এসব বিল ও গ্রামের পানি নিষ্কাশনের পথ বেতনা, মরিচ্চাপ ও সীমান্তের ইছামতি নদী। এসব নদী বিল ছাড়া উঁচু হয়ে গেছে। ফলে প্রতি বছর বিলগুলো জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। এতে করে আমনের পাশাপশি বোরো আবাদও অনিশ্চিত।
কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, জেলার মোট ১৪ লক্ষ ৩৪ হাজার ২০০ জন মানুষ সরাসরি কৃষির সাথে জড়িত। এসব কৃষকের মধ্যে বর্তমান বোরো চাষের সাথে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ জড়িত। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। যেমন-বৈরী জলবায়ুর (লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও অধিক তাপ সহিষ্ণু) সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো উচ্চফলনশীল ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এগুলোর ব্যবহার ও চাষাবাদ বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট, মলিকুলার ও বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। শস্যবীমা চালু করার কথাও ভাবা হচ্ছে।
কৃষি বিভাগের হিসাব মতে জেলাতে ৩ লক্ষ ৮১ হাজার ৭৩০ হেক্টর ফসলি জমি আছে। এসব জমিতে ৩ লক্ষ ৫৮ হাজার ৫৫০টি পরিবার কৃষি কাজ করে থাকে। এর মধ্যে ভুমিহীন চাষী রয়েছে ৬৭ হাজার ২৩০টি, প্রান্তিক চাষী রয়েছে এক লক্ষ ৩১ হাজার ৩৭টি, ক্ষুদ্র চাষীর সংখ্যা এক লক্ষ ৯৫৭টি, মাঝারি চাষী রয়েছে ৪৪ হাজার ৮৪২টি এবং বড় চাষী রয়েছে ১৪ হাজার ৪৮৪টি। মোট ১৪ লক্ষ ৩৪ হাজার ২শ’ ব্যক্তি সরাসরি কৃষির সাথে জড়িত। এসব কৃষকের মধ্যে বর্তমান বোরো চাষের সাথে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ জড়িত।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ঘামারবাড়ি) সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে সাতক্ষীরায় ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবার সবচেয়ে বেশি বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় এবং সবচেয়ে কম লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে শ্যামনগর উপজেলায়। বোরো মৌসুমে সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় ২৩ হাজার ৪১০হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ভিতরে হাইব্রিড জাতের ধানচাষের জন্য ৪ হাজার ৯১০ হেক্টর ও উফশী জাতের ধান চাষের জন্য ১৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। কলারোয়ায় ১২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ভিতরে হাইব্রিড জাতের ধানচাষের জন্য ২হাজার ১৫০ হেক্টর ও উফশী জাতের ধান চাষের জন্য ১০ হাজার ৪০০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। তালায় ১৯ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ভিতরে হাইব্রিড জাতের ধানচাষের জন্য ৫ হাজার ৮৫০ হেক্টর ও উফশী জাতের ধান চাষের জন্য ১৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। দেবহাটায় ৫ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ভিতরে হাইব্রিড জাতের ধানচাষের জন্য ২ হাজার ৮২০ হেক্টর ও উফশী জাতের ধান চাষের জন্য ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। কালিগঞ্জে ৫হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ভিতরে হাইব্রিড জাতের ধানচাষের জন্য ১হাজার ১০হেক্টর ও উফশী জাতের ধান চাষের জন্য ৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। আশাশুনিতে ৭ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ভিতরে হাইব্রিড জাতের ধানচাষের জন্য ৩ হাজার ৪০০ হেক্টর ও উফশী জাতের ধান চাষের জন্য ৪ হাজার হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং শ্যামনগর উপজেলায় ১ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ভিতরে হাইব্রিড জাতের ধানচাষের জন্য ৩৬০ হেক্টর ও উফশী জাতের ধান চাষের জন্য ১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। যথাক্রমে জেলার ৭টি উপজেলার ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের জন্য ৫০৫ হেক্টর জমি বীজতলা হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এর ভিতরে তবে ইতোমধ্যে ৪শ’ হেক্টরেরও বেশি জমিতে বীজ তলা প্রস্তত করা হয়েছে। প্রতি এক হেক্টর বীজ তলায় আবাদ হবে ১৬ হেক্টর জমি। হিসাবমতে ১০০ হেক্টর বীজ তলায় ১৬শ’ হেক্টর জমি আবাদ হবে। তবে চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে বোরো আবাদ হতে পারে বলে আশাবাদী সাতক্ষীরা কৃষিসম্প্রাসারণ অধিদপ্তরের (ঘামারবাড়ি) কর্মকর্তারা।
সার্বিক বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামারবাড়ি) সাতক্ষীরা’র উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: নুরুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্প্রতি কয়েক বছর ধানের দাম ভাল থাকায় চলতি বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আরও বেশি জমিতে বোরো আবাদ হতে পারে বলে জানান তিনি। এ সময় তিনি বলেন, জেলার ৭টি উপজেলার কৃষকদের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ঘামারবাড়ি)সহ ইউনিয়ন পর্যায়ে দায়িত্বরত কৃষি কর্মকর্তারা। কৃষকদের যেকোন প্রয়োজনে কৃষি কর্মকর্তারা পাশে থাকবেন বলে জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, জলাবদ্ধতা না থাকলে বোরোর আবাদ আরও বেশি হতো। জেলা খামার বাড়ির দরজা কৃষকদের জন্য খোলা আছে। কৃষকদের সার্বিক খোঁজ খরব নেওয়া হচ্ছে। তাদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।