১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিনা যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনী মুক্ত হয়েছিল ময়মনসিংহ জেলা। ১৯৭১ সালের ১০ই ডিসেম্বর তৎকালীন ঢালু যুব শিবির (ঢালু ক্যাম্প) এর প্রধান আলহাজ¦ অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার সিন শিং বাবাজীর নেতৃত্বে মিত্র বাহিনীর সম্মিলিত দল বিজয় পতাকা উড়িয়ে প্রবেশ করেন মুক্ত ময়মনসিংহ জেলা সদরে। সাকির্ট হাউজ মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতাকে সাথে নিয়ে ময়মনসিংহ শহরে বিজয় ও আনন্দ মিছিল করেন।
১৯৭১ সালের ৯ মাসে হানাদার বাহিনীর সাথে জেলায় প্রায় ৭০টির মতো সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এরমধ্যে ৩ নভেম্বর হালুয়াঘাটের তেলিখালী যুদ্ধ ও ময়মনসিংহের খাগডহর যুদ্ধ আজও মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে শিহরণ জাগায়। এই যুদ্ধে শহীদ হন প্রায় দুই শতাধিক মানুষ। এছাড়াও ৩২টি বৌদ্ধভূমি ও অসংখ্য টর্চারসেলে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয় অসংখ্য মানুষকে। নির্যাতন করা হয় মা বোনদের। কিন্তু আজও শনাক্ত করা হয়নি অনেক বৌদ্ধভূমি। অনেক গুলো আজো অযতœ আর অবহেলায় বেখল হয়ে আছে।
১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের চারদিকের আক্রমণে পাকহানাদার বাহিনী পালাতে শুরু করে। আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে অবশেষে পাক-বাহিনী সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাক, বাস-জিপ, কার এবং দমকল বাহিনীর গাড়িগুলোর চালকসহ বিডিআর ক্যাম্পে জড়ো করে। ওই দিন বিকেল থেকেই শহরে কারফিউ বলবৎ করা হয়। সাইরেন বাজিয়ে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় নিতে নির্দেশনা দেয়া হয় এবং সারা শহরে জনমনে ভীতির সঞ্চার করে। একপর্যায়ে পলায়নরত পাকবাহিনী ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল সড়কের পাশে খাগডহর এলাকার খাদ্যগুদামে প্রবেশ করে। সেখানে রাজাকারদের আটকিয়ে গোলাবারুদে আগুন দেয়। এ সময় গোলাবারুদের বিকট শব্দে সারা শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠে। এ কৌশলে তারা টাঙ্গাইলের মধুপুর হয়ে ময়মনসিংহ ত্যাগ করে। পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকবাহিনী ব্রহ্মপুত্র নদের উপর রেল ব্রীজটি ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে ফেলে। সকালে মসজিদে ফজরের আযান হয় গোলাবারুদের শব্দ বন্ধ হয়ে আসে এবং খন্ডখন্ড মিছিলে জয়বাংল শ্লোগানে-শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা শহর। এদিনে মুক্তির আনন্দে সোনালী সূর্যের রক্তিম আভায় মিশে গিয়েছিল স্বজন হারানোর ব্যথা। শহীদ পরিবারের স্বজনরা তাদের হারানো সন্তানদের খোঁজে ছুটে যায় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় ও বালুচরসহ পাকসেনাদের ক্যাম্পগুলোতে।
ময়মনসিংহ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হালুয়াঘাটের তেলিখালী যুদ্ধ। বিমল পাল আজও ভুলতে পারেন না সেই যুদ্ধের কথা। ২ নভেম্বর রাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা “আক্রমণ করো এবং দখল করো” নীতিতে প্রস্তুত। তেলিখালীতে পাকিস্তানি সেনাদের সব বাংকার দখলের জোর চেষ্টা চালাচ্ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। তখন ভোর, সুর্যের আলো ফুটেনি। সবকিছু আবছা আবছা দেখা যায়। ৩৩ পাঞ্জাবের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের পাকিস্তানিদের বাংকারটি দখলে আনতে গুলি করছে শামছুল হকসহ মুক্তিযোদ্ধা। সঙ্গে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ইদ্রিস। গোলাগুলির শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটাই লক্ষ্য, সব কটাকে মেরে ওদের বাংকার দখল করতে হবে। হঠাৎ একটা গুলি শামছুল হকের ডান হাতের কনুইয়ে লাগে। গুলিটা কনুই ভেদ করে লাগে ইদ্রিসের বুকে। ইদ্রিস লুটিয়ে পড়ে। ইদ্রিস কিছু একটা বলতে চাইলেও বলতে পারেনি। তার আগেই সে শহীদ হয়।
বিমল পাল বলেন, ‘ইদ্রিস কী বলতে চেয়েছিল, সেটা বলতে না পারলেও শামছুল হকসহ আমরা ধরে নিয়েছিলাম সে বলেছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।
বীরমুক্তিযোদ্ধা সেলিম সরকার বলেন, ৬ ও ৭ নভেম্বর ফুলপুর ও সঞ্চাপুর যুদ্ধ শেষে ৮ তারিখ তারাকান্দা হয়ে শম্ভুগঞ্জ আসি। এসে দেখি ব্রহ্মপুত্র নদের উপর একমাত্র রেল ব্রীজটি ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে ফেলে। পরে আমরা বিকল্প পথে ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করি। আমাদের প্রবেশের খবর জানতে পেরে পাকবাহিনী ৯ তারিখ রাতের আঁধারে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। শহরের প্রবেশ করে আমরা বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে কোথায় খুঁজে পায়নি পাকবাহিনীকে।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন জানান, বিজয়ের ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও শনাক্ত করা হয়নি অনেক বৌদ্ধভূমি। দখল হয়ে যাচ্ছে অনেক বৌদ্ধভূমির জায়গা। যখন দেখি বৌদ্ধভূমি জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে বড় বড় বিল্ডিং তখন কষ্ট হয়। এখনও অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করা স্মৃতিসৌধ, গণকবর, বধ্যভূমি। তিনি বর্তমান সরকারের কাছে এগুলো সংরক্ষণের দাবি জানান।