নালায় পড়ে মৃত্যুর সারিতে এর পরে কে যুক্ত হবেন? তার জন্য হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদিও সালেহ আহমদ, সাদিয়া, খতিজা, সুলতান ও কামালের পর আর কোনো দুর্ঘটনা কাম্য নয়। শুধু চট্টগ্রাম নয়, আমরা সারাদেশেই নালা বা ম্যানহোলগুলোর যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছি। দেশের নাগরিক হিসেবে এটি আমাদের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে একের পর এক মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন পথচারীরা। নগরীর পয়ঃনিষ্কাশনের নালাগুলো একেকটা হয়ে উঠছে মৃত্যুফাঁদ। চট্টগ্রামের মতো সারাদেশেই যেন এ অবস্থা বিরাজ করছে। জলাবদ্ধতার কারণে কিংবা নালার পাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় হাঁটতে হাঁটতে পথচারীরা পড়ে যাচ্ছেন। খুঁজে পেতে পেতে পেরিয়ে যায় অনেকটা সময়। অবশেষে উদ্ধার করা হয় তাদের মৃতদেহ। কাউকে আবার খুঁজেই পাওয়া যায় না। গত কয়েক বছরে অর্ধডজনের বেশি পথচারীর মৃত্যু মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কিন্তু এর দায়ভার নিতে চাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে পথচারীদের মধ্যে আতঙ্ক এবং ক্ষোভ দিনদিন বেড়েই চলেছে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, গত ১৯ জুন বন্দরনগরীর চান্দগাঁও থানার 'বি'-বস্নক এলাকায় বৃষ্টির মধ্যে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে একটি সিএনজি অটোরিকশা নালায় পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও তাদের নিয়ে যেতে হয় হাসপাতালে। তবে ৩০ জুন নগরের ২ নম্বর গেটের মেয়র গলিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা নালায় পড়ে যায়। ওই ঘটনায় মারা যান অটোরিকশায় থাকা খতিজা বেগম ও চালক সুলতান।
অপরদিকে ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে সালেহ আহমদ নামের এক পথচারী নালায় তলিয়ে যান। বর্জ্যে ভরা ওই খালে ও আশপাশের কয়েকটি খালে টানা কয়েকদিন অভিযান চালিয়েও তার খোঁজ মেলেনি। গত ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ এলাকার একটি নালায় তলিয়ে মারা যান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া। রাত ১০টার দিকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পা পিছলে পাশের একটি নালায় পড়ে যান তিনি। এর প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর তার মরদেহ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম দমকল বাহিনী।
সবশেষে গত ৬ ডিসেম্বর ষোলশহরের চাঁন্দগাও সার্কেলের ভূমি অফিসের সামনের খালে কামাল (১০) নামে এক শিশুও নিখোঁজ হয়। তবে গত ৭ ডিসেম্বর বিকালে বিষয়টি জানাজানি হয়। চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমরা স্থানীয় এক গণমাধ্যমকর্মীর কাছে খবর পেয়ে মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) বিকাল ৪টা থেকে অভিযান শুরু করি। এরপর রাত ১০টা পর্যন্ত অভিযান চালাই। ৮ ডিসেম্বর সকাল থেকে আবারও উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ময়লার মধ্যে শিশুটি আটকা পড়ে থাকতে পারে।'
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এ ঘটনা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে, চট্টগ্রাম শহর পথচারী কিংবা নগরবাসীর জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা চট্টগ্রামে নালায় পড়ে গত কয়েক বছরে একে একে অর্ধডজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও স্থানীয় দুই সংস্থাকে দাঁড় করানো হচ্ছে আসামির কাঠগড়ায়। যদিও এসব মৃত্যুর দায় নিতে চায় না চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)-কোনো সংস্থাই। সংস্থা দুটি পরস্পরের ওপর দায় চাপিয়েই নিজেদের দায় সারতে চাইছে।
শুধু চট্টগ্রামেই নয়, রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মাঝেমধ্যেই এমন ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ২০১৫ সালে কুমিলস্না সিটি করপোরেশনের নালায় পড়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছিল গণমাধ্যম। ঢাকায়ও ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলে পড়ে শিশুর মৃত্যুর ঘটনাও নতুন কিছু নয়। তাই এই নালা ও ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
কেননা আমরা দেখতে পাই, নালায় তলিয়ে সালেহ আহমদ নিখোঁজের পর চসিক-সিডিএ পরস্পরকে দোষারোপ করেছে। একপর্যায়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দায়ী কে তা জানতে চান চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কাছে। মন্ত্রিপরিষদের চিঠি পাওয়ার পর গত ২ অক্টোবর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাদের তদন্তে ঘটনায় মূল দায়ী করা হয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ)। একই ঘটনায় নগরের প্রধান সেবা সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) দায়িত্বহীনতার বিষয়টিও উঠে আসে। যদিও পরে নিখোঁজ সবজি ব্যবসায়ী সালেহ আহমদের ছেলেকে চাকরি দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (সিসিসি)। অপরদিকে সাদিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গত ৫ ডিসেম্বর রুল জারি করেছেন আদালত। একই সঙ্গে যেখানে সাদিয়া মারা গেছেন; সেখানকার প্রকৃত অবস্থা কেমন, এ বিষয়ে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এক পশলা বৃষ্টি হলেই নগরীর সড়ক যেন হয়ে ওঠে মরণফাঁদ। জলাবদ্ধতার পানিতে সড়ক-নালা-খাল একাকার হয়ে যায়। তখন সড়ক আর নালা আলাদা করে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। নালা প্রশস্তকরণের কাজ চললেও রাখা হয় না কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তা ছাড়া রাস্তার পাশে অনেক গভীর নালা ও খাল আছে-যাতে কাঁটাতারের বেড়া বা সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। লাল পতাকা উড়িয়ে দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বা জায়গাও চিহ্নিত করা হয় না। মূলত এসব কারণেই অরক্ষিত নালায় পড়ে প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে।
শহরের মধ্যে এ শাখা নালাগুলো বেশ প্রশস্ত এবং উন্মুক্ত। নালাগুলো রাস্তা থেকে বেশ গভীর ও বর্জ্যে ঠাসা। একই সঙ্গে এগুলো গিয়ে মিশেছে মূল নালার সঙ্গে, যা প্রধান সড়কের নিচে। সুতরাং এখানে কেউ পড়লে বড় দুর্ঘটনার শঙ্কা থেকেই যায়। এ ছাড়া চট্টগ্রামে যখন বৃষ্টি হয়; তখন রাস্তা এবং নালাগুলো আলাদা করা যায় না। ঘটনাগুলোর সময় প্রচন্ড বৃষ্টি ছিল এবং পানির ¯্রােত ছিল। উদ্ধারকাজে যারা ছিলেন; তারা বেশিক্ষণ সেখানে থাকতে পারেননি। কারণ এতে তাদের ঝুঁকি তৈরি হতো।
তাই নালাগুলো এখন মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে। কেউ রিকশায় থাকুক বা হেঁটে যাক-যেভাবেই রাস্তা দিয়ে যাক না কেন, অন্য দুর্ঘটনার পাশাপাশি এখন এই নালায় পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও বিরাট ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনাই পথচারীদের কাছে খুব ভয়াবহ। একবার পড়ে গেলে নিমিষেই তলিয়ে যাচ্ছে মানুষ। যদি নালাগুলো ঢাকা থাকে তাহলে হয়তো দুর্ঘটনা ঠেকানো সম্ভব হতে পারত। সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে এবং কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে এমন প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে বলে দবি করছে ভুক্তভোগীর পরিবার।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদুল আলম অবশ্য গণমাধ্যমকে বলেছেন, শহরের মধ্যে এই ড্রেনগুলোর বর্জ্য পরিষ্কার, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য প্রকল্প চালু আছে। কাজগুলো শেষ হলে নালাগুলো ঢেকে দেওয়ার কাজ করা হবে পর্যায়ক্রমে। তবে শহরে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কতগুলো নালা আছে, তার কোনো হিসাব তিনি দিতে পারেননি।
এখন আমার প্রশ্ন, জনগণের নিরাপত্তা, জান-মালের দায়ভার নেওয়া কি তাদের নৈতিক দায়িত্ব নয়? যখন কাজ শুরু হয়; তখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেন জোরদার করা হয় না? জান-মালের ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে, তারা কেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? আমরা হয়তো প্রশ্ন করেই যাবো, উত্তর আদৌ পাবো কিনা জানি না। যারা তাদের স্বজনদের হারিয়েছেন, তাদের কী বলে সান্ত¡না দেওয়া যেতে পারে? দু-একজনকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে বা ক্ষতিপূরণ দিলেই কি দায় এড়ানো যায়? হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের কি তারা ফেরত দিতে পারবেন? এ ছাড়া দুর্ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ একে অপরকে দোষারোপ করে কেন দায় এড়াতে চান? এর সঠিক কোনো সমাধান কি আসলেই নেই? থাকলে তা অতি দ্রম্নত বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন?
নালায় পড়ে মৃত্যুর সারিতে এর পরে কে যুক্ত হবেন? তার জন্য হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। যদিও সালেহ আহমদ, সাদিয়া, খতিজা, সুলতান ও কামালের পর আর কোনো দুর্ঘটনা কাম্য নয়। শুধু চট্টগ্রাম নয়, আমরা সারাদেশেই নালা বা ম্যানহোলগুলোর যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছি। দেশের নাগরিক হিসেবে এটি আমাদের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার নিশ্চিত করতে না পারলে সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক