এ বছরও সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতায় ফিকে হয়ে গেছে হেমন্তের নবান্ন উৎসব। জেলার অধিকাংশ বিল ডুবে থাকায় এ বছর নবান্নের উৎসবে মেতে উঠতে পারেনি কৃষক। যেবিলগুলোতে থাকার কথা সোনালী ধানের সমারোহ সেই বিলগুলো এখনো পানিতে থৈ থৈ করছে। আমন ফসল থেকে বঞ্চিত হয়েছে হাজার হাজার কৃষক। হেমন্তের এই দিনে যেগ্রামগুলোর উঠোন ভরা থাকতো নতুন ধানের পালায়, সেই উঠোনে এবার এক আঁটি ধানও দেখা যায়নি। নবান্নের দিনে যে কৃষাণী ব্যস্ত থাকতেন ঘর গোছাতে সেই কৃষাণী এবার অলস সময় পার করছেন। কপালে তার চিন্তার ভাজ। বোরো আবাদ নিয়েও কৃষক রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। বিলের পানি যে এখনো শুকায়নি তার! রোদে শুকানো ছাড়া পানি কমার কোন পথ নেই।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মো: আনিসুর রহিম বলেন, পয়লা অগ্রহায়ন বাঙালির নবান্ন উৎসব। ফসলকেন্দ্রিক সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন উৎসবে মেতে ওঠার দিন। নতুন ধানে হয় নবান্ন। অনাদিকাল ধরে গ্রামীণ জনপদে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। লোকায়ত জীবন ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জয়গান করা হয় নবান্ন উৎসবে। শহর ও গ্রাম সর্বত্রই লাগে আনন্দের ঢেউ। মরা কার্তিকে কৃষকের গোলা শূন্য হয়ে গেলে খাবারের অভাব দেখা দেয়। সবাই তখন তাকিয়ে থাকে অগ্রহায়ণের দিকে। এবারও সাতক্ষীরার কয়েক লক্ষ কৃষক তাকিয়ে ছিলেন হেমন্তের মাঠের দিকে। কিন্তু সর্বনাশা জলাবদ্ধতা কৃষকের মুখের হাসি কেড়ে নেয়। আমন হারা কৃষক পরিবারে এবার হেমন্তদিনে দেখা যায়নি নবান্নের আয়োজন। আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার বোরো চাষে কোমর বাঁধছেন কৃষকরা।
নাগরিক নেতা এড: ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নতুন চালের রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব শুরু হয়। হাজার বছর ধরে নবান্ন উৎসব উদযাপন হয়ে আসছে। ঘরে ফসল তোলার আনন্দে এ উৎসবের আয়োজন করা হতো। কিন্তু সাতক্ষীরায় প্রায় অর্ধ শতাধিক বিল বিগত কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধতার কারণে ডুবে থাকে। এসব বিলে আমন চাষ করতে পারে না কৃষক। এবছর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বিলগুলোর পানি এখনো শুকায়নি। ফলে বোরো আবাদেও সংশয় রয়েছে।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, জেলার দাঁতভাঙ্গা, মালিনি, হাজিখালি, বুড়ামারা, পালিচাঁদ, চেলারবিল, ডাইয়ের বিল, ঘুড্ডির বিল, কচুয়ার বিল, ঢেপুর বিল, লাবসার বিল, বল্লীর বিল ও পদ্মবিলসহ অর্ধশতাধিক বিল এখনও ফসল শূন্য। এসব বিল ও গ্রামের পানি নিষ্কাশনের পথ বেতনা, মরিচ্চাপ ও সীমান্তের ইছামতি নদী। এসব নদী বিল ছাড়া উঁচু হয়ে গেছে। ফলে প্রতি বছর বিলগুলো জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে। এতে করে আমনের পাশাপশি বোরো আবাদও অনিশ্চিত। তবে বোরো চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
এদিকে সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অর্জন হয়েছে ৮৯ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে। অথচ এ সময় অর্ধশতাধিক বিল ছিল পানিতে নিমজ্জিত। আমন মৌসুমে বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতার শিকার হয় বিলগুলো। এতে করে কৃষক আমন চাষ করতে পারে না। অপরদিকে বোরো মৌসুমে আবহাওয়া শুষ্ক থাকে। বিলের পানিও এ সময় কমতে থাকে। ফলে আমনের তুলনায় বোরো আবাদের পরিমাণ বেশি হওয়ার কথা থাকলেও সাতক্ষীরায় তা কমেছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১৫ সালে জেলায় ৯৪ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়। ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৮৪ হাজার ৩৫৫ হেক্টরে। ২০১৭ সালে জেলায় ৮৩ হাজার ৭৬৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়। ২০১৮ সালে ৬০ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়। ২০১৯ সালে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয় ৮৯ হাজার ২২৯ হেক্টর জমিতে। ২০২০ সালে ৮৯ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের টার্গেট করা হয়। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে আমন মৌসুমে বিগত ১০ বছরের অধিক সময় প্রায় অর্ধশতাধিক বিল পানিতে ডুবে থাকে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা থাকলেও সর্বনাশা জলাবদ্ধতার কারণে তা পূরণ হয় না। এতে করে জেলার প্রায় ৫৬ হাজার হেক্টর নিচু জমিতে বোরোর আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানায় একাধিক সূত্র।
সাতক্ষীরায় মোট এক লক্ষ ৭৭ হাজার ৮১৪ হেক্টর জমির মধ্যে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় এক লক্ষ ৩১ হাজার ৭৮৮ হেক্টর। এর মধ্যে স্থায়ী পতিত জমি প্রায় ৪৫ হাজার ১১০ হেক্টর। এর বাইরে চাষযোগ্য জমির মধ্যে মাঝারি ও নিচু জমির পরিমাণ ৪৬ হাজার ৮০৪ হেক্টর। এসব জমির বেশির ভাগ অংশ এখনো পানির নিচে। চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতার কারণে ৫৫ হাজার ৭৮৮ হেক্টর জমিতে এবার বোরো চাষ অনিশ্চিত।
কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, জেলার মোট ১৪ লক্ষ ৩৪ হাজার ২০০ জন মানুষ সরাসরি কৃষির সাথে জড়িত। এসব কৃষকের মধ্যে বর্তমান বোরো চাষের সাথে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ জড়িত। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। তবে পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। যেমন-বৈরী জলবায়ুর (লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা ও অধিক তাপ সহিষ্ণু) সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো উচ্চফলনশীল ফসলের নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন করা হচ্ছে। এগুলোর ব্যবহার ও চাষাবাদ বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার। কৃষিতে তথ্য প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট, মলিকুলার ও বায়োটেকনোলজি প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। শস্যবীমা চালু করার কথাও ভাবা হচ্ছে।
সার্বিক বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামারবাড়ি) সাতক্ষীরা’র উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: নুরুল ইসলাম জানান, চলতি মৌসুমে ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্ষাকালে আমন চাষ হয়। তখন লবণাক্ততা কম থাকে। ফলে আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, দেবহাটাসহ অন্যান্য এলাকায় আমন চাষ হলেও বোরো মৌসুমে হয়না। তিনি বলেন, জেলার ৭টি উপজেলার কৃষকদের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে দায়িত্বরত কৃষি কর্মকর্তারা। কৃষকদের যেকোন প্রয়োজনে কৃষি কর্মকর্তারা পাশে থাকবেন বলে জানান তিনি। জলাবদ্ধতা না থাকলে বোরোর আবাদ আরও বেশি হতো। জেলা খামার বাড়ির দরজা কৃষকদের জন্য খোলা আছে। কৃষকদের সার্বিক খোঁজ খরব নেওয়া হচ্ছে। তাদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।