রাজশাহীর পুঠিয়া থানার বহুল আলোচিত সেই শ্রমিক নেতা মো. নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় কারসাজির মাধ্যমে এজাহার পরিবর্তনের দায়ে অভিযুক্ত ওই থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাকিল উদ্দিন আহমেদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এরপর বিশেষ নিরাপত্তার মাধ্যমে তাকে রোববার (১২ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর আগে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিন আবেদন করেছিলেন।
এ তথ্য নিশ্চিত করে ওসি শাকিলের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আসলাম সরকার জানান, গত বুধবার (৮ ডিসেম্বর) রাজশাহীর বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ওই দিন আদালতে মামলার মূল নথি না থাকায় জামিন আবেদন শুনানির দিন ধার্য করা হয় রোববার (১২ ডিসেম্বর)। এদিন শুনানির আগ পর্যন্ত ওসি শাকিল উচ্চ আদালতের দেয়া জামিন সুবিধায় ছিলেন। মামলা সুত্রে জানা গেছে, পুঠিয়া থানায় ওসির দায়িত্ব থাকাকালে পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলের প্রবিধান ২৪৩ ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন পূর্বক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধমূলক অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ মতে তিনি পুঠিয়া থানার শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলাম হত্যা মামলায় ৮ জন আসামির নাম উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও এই আসামিদেরকে সাজা বাঁচাবার উদ্দেশে এবং সংবাদদাতার ক্ষতি সাধনকল্পে আইনের নির্দেশ অমান্য করেন। কারসাজিমূলকভাবে এই এজাহার পরিবর্তন করে প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে আসামির নাম-ঠিকানা সম্বলিত কলামে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ লিপিবদ্ধ করে স্বাক্ষরপূর্বক মামলা রুজু করেন।
এই অপরাধে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন বাদী হয়ে ২৪ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, রাজশাহী দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় মামলা করেন। এ মামলায় বিচারিক আদালতেই আত্মসমর্পণের জন্য শাকিলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো বিচার বিভাগীয় তদন্তে সত্য বলে প্রমাণিত হওয়ায় বর্তমানে ওসি শাকিল সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় আছেন। এর আগে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নুরুল হত্যা মামলায় বাদীর দায়ের কার এজাহার পাল্টে দেওয়ার অভিযোগে ওসি শাকিলের বিরুদ্ধে বিচারিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত।
এদিকে দুদকের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, নিহত নূরুল ইসলাম পুঠিয়া থানার সড়ক ও পরিবহন মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ২০১৯ সালের ২৪ এপ্রিল শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে আবারও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং সর্বোচ্চ ভোট পান। কিন্তু নির্বাচন পরিচালনা কমিটি ফল পরিবর্তন করে আবদুর রহমান পটল নামে এক ব্যক্তিকে সাধারণ সম্পাদক পদে বিজয়ী ঘোষণা করে। এ নিয়ে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ করে নূরুল ইসলামসহ তিনজন বাদী হয়ে মামলা করেন। এরপর থেকে আবদুর রহমান পটল এবং তার সহযোগীরা নুরুল ইসলামকে বিভিন্নভাবে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিলেন।
এরপর ২০১৯ সালের ১০ জুন থেকে নুরুল ইসলাম নিখোঁজ হন। গত ১১ জুন রাজশাহীর পুঠিয়া থানাধীন কাঠালবাড়ীয়া এলাকার এএসএস ইটভাটা থেকে শ্রমিক নেতা নুরুল ইসলামের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত নুরুল ইসলাম ওই উপজেলার ধোপাপাড়া গ্রামের মৃত কালুর ছেলে। এ ঘটনায় সেদিনই তার মেয়ে নিগার সুলতানা আটজনের নাম উল্লেখ করে পুঠিয়া থানার তৎকালীন ওসিকে একটি এজাহার দেন। সেই এজাহারে শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে পুঠিয়ার ওসির অবৈধ হস্তক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। এ কারণে ওসি সাকিল উদ্দীন আহমেদ এজাহারটি রেকর্ড না করে নিগার সুলতানাকে তা সংশোধন করতে বলেন। নিগার সুলতানা ওসির বিষয়টি বাদ দিয়ে পুনরায় থানায় এজাহার দাখিল করেন। তখন এজাহারটি গ্রহণ করেন এবং কিছু সাদা কাগজে নিগার সুলতানার স্বাক্ষর নিয়ে তাকে চলে যেতে বলেন।
পরবর্তীতে নিগার সুলতানা পুঠিয়া থানা থেকে এজাহার ও মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর কপি সংগ্রহ করে দেখেন, প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে আসামিদের নাম-ঠিকানা লেখার কলামে ‘অজ্ঞাতনামা’ লেখা আছে। আবার তার উল্লেখ করা আটজন আসামির পরিবর্তে সেখানে ছয়জনের নাম আছে। অথচ তিনি পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানাসহ আটজনকে আসামি করেছিলেন। এ ঘটনায় নিগার সুলতানা এই বিতর্কিত এজাহারের বিরোধিতা করে হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট রাজশাহীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্ত করে প্রতিবেদন পাঠানোর নির্দেশনা দেন। এরপর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান তালুকদার বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে ওসির কারসাজির বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
ওসির বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার এজাহারে আরো বলা হয়, ওসি সাকিলের এজাহার পরিবর্তনের বিষয়টি পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গলের প্রবিধান ২৪৩ ও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ধারার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তিনি দন্ডবিধির ১৬৬/১৬৭/২১৭/২১৮ ধারাসহ ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।