শীতকালে হানা দিলো ঘুর্ণিঝড় এবং অকস্মাৎ ল-ভ- করে দিলো বিপুল সংখ্যক মানুষের আবাদি ফসল। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সদ্য হানা দেওয়া জাওয়াদের তান্ডবে অসহায় হয়ে পড়েছে। অকস্মাৎ ফসল বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় তাদের দুঃখের শেষ নেই। অনেক কৃষকের আর্তনাদের ভিডিও ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হতে দেখা যাচ্ছে।
জানা যায়, খুলনা, ধামরাই ও সুবর্ণচরসহ বৃষ্টিতে দেশের ৩২ জেলার লাখো কৃষকের ক্ষেতের ফসল আক্রান্ত হয়েছে। তবে এখনো ক্ষতির তথ্য চূড়ান্ত করতে পারেনি কৃষি মন্ত্রণালয়।
অগ্রহায়ণের এই ঝড়-বৃষ্টি খনার বচনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে- 'যদি বর্ষে আগুনে রাজা যায় মাগনে'। এ বছর কৃষির বড় ক্ষতির কারণে কৃষক বড় সংকটে পড়বেন। পাশাপাশি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। এ অবস্থায় দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও শস্যের সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করে সহজ শর্তে ঋণ, সুদ মওকুফ, বীজ, সার ও উপকরণ সহায়তা দিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে। দ্রুত এ কাজগুলো করতে হবে, কারণ কৃষক পুনরায় চাষ করতে দেরি করলে পরের ফসলগুলো দেরি হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ৩২ জেলায় ২৫ লাখ ২০ হাজার ২৫৪ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়েছে। বর্তমানে এসব জেলায় দ ায়মান জমির পরিমাণ ১৫ লাখ ১২ হাজার ৬১১ হেক্টর। আক্রান্ত ফসলি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৯৫ হাজার ৪৯১ হেক্টর। আক্রান্ত হয়েছে ২২ ধরনের ফসল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আলু, পেঁয়াজ ও খেসারির ডালের। এগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। ৫০ শতাংশ শীতকালীন সবজির ক্ষতি হয়েছে। আমন ধান ৬৫ শতাংশ কাটা হয়েছে। বাকি ৩৫ শতাংশ একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট বৃষ্টিতে আক্রান্ত হয়েছে এমন জেলাগুলো হলো- ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, ভোলা, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগেই ক্ষতি হয়েছে ৬১ হাজার ৭৫২ হেক্টর জমির ফসল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে উপকূলীয় ও মধ্যাঞ্চলে ভেসে গেছে ঘের ও পুকুরের মাছ, শুঁটকির মহাল। খুলনায় প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। শাকবাড়িয়া নদীর পানির তোড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের দুটি গ্রামের মানুষ এখনও পানিবন্দি। চাঁদপুরের মতলব উত্তরের মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের বেড়িবাঁধের ভেতরে প্রায় ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে খুলনার কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের হরিহরপুর গ্রামের বেড়িবাঁধ ভেঙে দুটি গ্রামে পানি ঢুকে প্রায় ২০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য হরষিৎ কুমার ম-ল বলেন, ‘আমাদের হাহাকার কেউ শুনছে না। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ডুবেছি। এখন জাওয়াদে আবার ডুবলাম।’
বাগেরহাটে কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি আবার কখনো বা টানা বৃষ্টি হচ্ছে বলে জানা যায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নদণ্ডনদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃষ্টিপাতের কারণে মোংলা বন্দরে জাহাজে মালপত্র ওঠানো-নামানোর কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় দুই থেকে আড়াই ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
বরগুনায় বৃষ্টির সঙ্গে দমকা বাতাসে ক্ষেতে নুয়ে পড়েছে আমন ধান। কৃষকরা আমন ও খেসারির ডালের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করেছেন। তবে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ভারি বৃষ্টি না হলে ফসলের তেমন ক্ষতি হবে না।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার নিচু এলাকার বেশ কিছু জমির পাকা ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আবার অনেকেই কাটা ধান জমিতে রেখে এসেছে। সেগুলো তলিয়ে গেছে পানিতে। টানা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ঝিনাইদহ জেলার নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বোরো ধানের বীজতলা, সরিষাসহ রবি ফসল ও সবজির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
সাতক্ষীরায় ভারি বর্ষণে ডুবে গেছে জেলার ২০ শতাংশ আমন ধান। বিশেষ করে কেটে রাখা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরিষা, আলু, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন শীতকালীন সবজির ক্ষেত পানিতে ডুবে যাওয়ায় পচন দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
টানা বৃষ্টিতে যশোরের শার্শায় ডুবে গেছে উঁচু-নিচু সব জমির ধান। বৃষ্টিতে দুশ্চিন্তায় কৃষকরা।
দুই দিনের বৃষ্টিতে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, খিরা, আলু, বাঁধাকপি ও ফুলকপি, টমেটো, লাউসহ প্রায় এক হাজার হেক্টর জমির সবজির ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
টানা বৃষ্টিতে পটুয়াখালীতে আমন ধানের পাশাপাশি শীতকালিন শাক-সবজি এবং মৌসুমি তরমুজ আবাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। রাঙ্গাবালী উপজেলায় নদণ্ডনদীর পানি বেড়েছে দুই থেকে আড়াই ফুট। এতে ফসলের ক্ষেত পানিতে ডুবে গেছে। অতিবর্ষণ ও ঝোড়ো বাতাসে হেলে পড়েছে ক্ষেতের পাকা ধান।
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জানান, পরিপক্ব ধানগাছ নুয়ে পড়লেও সমস্যা হবে না। তবে খেসারি, তরমুজ ও শীতকালিন শাক-সবজির ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। জমিতে পানি জমলে দ্রুত অপসারণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
আলু উৎপাদনের শীর্ষ জেলা মুন্সীগঞ্জে আলু নিয়ে কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে হওয়া বৃষ্টিতে সদ্য রোপণ করা আলুবীজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।
একই অবস্থা কুমিল্লায়। বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে সদ্য রোপণ করা আলুক্ষেত। এতে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার আলু চাষিরা।
তবে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ফসলের উপকার হয়েছে মেহেরপুরে। গত দুই দিনের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে সতেজ হয়ে উঠেছে আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপি, শিম, কলা, বরবটি, লাউসহ বিভিন্ন সবজির ক্ষেত। বৃষ্টি কম হওয়ায় বোরো বীজতলারও উপকার হয়েছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিএসই) মো. আসাদুল্লাহ বলেন, ‘সারা দেশে আমন ধানের ৭৫ শতাংশই মাঠ থেকে উঠে গেছে। ফলে বৃষ্টিতে ধানের তেমন ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তা ছাড়া বৃষ্টিও থেমে গেছে। তবে সরিষা, আলুসহ কয়েকটি ফসল যারা নতুন আবাদ করেছে, তাদের সেই উঠতি ফসলের কিছু ক্ষতি হতে পারে। বৃষ্টি যদি আরো হয় এবং সঙ্গে বাতাস থাকে, তাহলে গম, ভুট্টা, সরিষাসহ প্রায় সব ফসলেরই ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।’