ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের চতুর্থ ও পঞ্চম ৫ম ধাপকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এরইমধ্যে সমর্থক থেকে শুরু করে নির্বাচন প্রার্থী অনেকেই নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, পাবনা সদর উপজেলার ভাঁড়ারা ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় ইয়াসিন আলী (৫০) নামের আনারস প্রতীকের এক স্বতন্ত্র প্রার্থী নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও ১০ জন।শনিবার ভোরে এ সংঘর্ষ ঘটে। পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম জুয়েল এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, পাবনা সদরের ভাঁড়ারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে গোলাগুলি, বাড়িঘর ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আনারস প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াসিনসহ ১০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে ইয়াসিনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে পাঠানো হলে শনিবার দুপুর ১টার দিকে মৃত্যু হয় তাঁর। এ ঘটনায় এলাকায় তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ইয়াছিন আলমের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম বলেন, নিহতের বাবা মোজাম্মেল হক খান বাদি হয়ে শনিবার মধ্যরাতে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ খানকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩৪ জনকে নামীয়সহ আরও ৪০ থেকে ৫০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।
এর আগে শনিবার ঘটনার পর ভাড়ারা ইউপির নলদহ চেয়ারম্যানপাড়া পাকা রাস্তার ওপর থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন ও এক রাউন্ড গুলিসহ দুজনকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তারাও এই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। তারা হলেন, নলদহ গ্রামের দিরাজ সরদারের ছেলে নজরুল সরদার (২৪ ) ও বকুল খানের ছেলে মুন্নাফ খান (২২)।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ভাড়ারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদের নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। পাবনা জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ঝিনাইদহে আসন্ন ইউপি নির্বাচনে দুই মেম্বর প্রার্থীর সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হয়েছে বলেও জানা গেছে। রোববার সকালে হরিণাকুন্ডু উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়নের শ্রীফলতলা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, আগামী ৫ জানুয়ারী ৫ম ধাপের ইউপি নির্বাচনে রঘুনাথপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রীফলতলা গ্রামে সাইদুল ইসলাম ও রেজাউল ইসলাম মেম্বর পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে। রোববার সকালে গ্রামের একটি চায়ের দোকানে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে সাইদুলের সমর্থক জমির লস্করকে মারধর করে রেজাউলের সমর্থক আজিজ উদ্দিন। এরই জের ধরে উভয় পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে। এতে উভয় পক্ষের কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়। আহতদের উদ্ধার করে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল ও হরিনাকুন্ডু উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এলাকায় উত্তেজনা থাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
ফেনী সদরে ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনের দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর বাড়িতে হামলা করে ব্যাপক ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই দুজনই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। হামলা ও ভাঙচুরের জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থীর (নৌকা প্রতীক) কর্মী-সমর্থকদের অভিযুক্ত করে ফেনী সদর মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। হামলার সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থী নিজে উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।
জানা যায়, শুক্রবার রাতে ফেনী সদর উপজেলার ছনুয়া ইউপির দুই প্রার্থীর বাড়িতে পৃথকভাবে এ হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. করিমুল্লাহ ছনুয়া ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান ও ফেনী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে রয়েছেন।
পুলিশ ও স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, শুক্রবার রাত সাতটার দিকে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী যুবলীগ নেতা সাইফুল ইসলাম পাটোয়ারীর বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এর প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ইব্রাহিমের বাড়িতেও হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলাতেও ঘটেছে একই ঘটনা। সদর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান মো. অহিদুল ইসলামের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে অহিদুল ইসলাম এবং তাঁর দুই কর্মী বাদল হোসেন ও মো. পিয়াস আহত হয়েছেন। নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী হামিদুর রহমানের কর্মীরা এ হামলা করেছেন বলে অভিযোগ করেছে ভুক্তভোগীরা। এ সময় নৌকার এক কর্মী পিস্তল উঁচিয়ে হত্যার হুমকি দেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মীদের চার-পাঁচটি মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করেন হামলাকারীরা।
আহত তিনজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় শনিবার দুপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থী (আনারস প্রতীক) অহিদুল ইসলাম পুলিশ সুপার ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
লিখিত অভিযোগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চতুর্থ ধাপে ২৬ ডিসেম্বর ঘিওর উপজেলার সাতটি ইউপি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ঘিওর ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হামিদুর রহমান। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমান চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম। শুক্রবার বিকেলে চারটার দিকে ইউনিয়নের বাটরাকান্দি গ্রামে সাত-আটজন কর্মী নিয়ে অহিদুল ইসলাম নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। এ সময় নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী হামিদুর রহমানের কর্মীরা হামলা চালান। এ সময় লোহার রড, দা, বাঁশ-কাঠের লাঠির আঘাতে চেয়ারম্যান প্রার্থী অহিদুল ইসলাম এবং তাঁর দুই কর্মী বাদল হোসেন ও মো. পিয়াস আহত হন। হামলাকালে চার-পাঁচটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। এ সময় নৌকা প্রতীকের এক কর্মী বাদলের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি দেন। এ সময় নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে অহিদুল ইসলামকে ভয়ভীতি দেখানো হয়।
এ সময় গ্রামের সাধারণ লোকজন এগিয়ে এলে হামলাকারীরা চলে যান। এরপর আহত চেয়ারম্যান প্রার্থী অহিদুল ইসলাম এবং বাদল ও পিয়াসকে জেলা সদরের ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ বিষয়ে আহত অহিদুল ইসলামের ভাষ্য, ‘আমি গত নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীদের পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলাম। নির্বাচিত হওয়ার পর এলাকার সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। এবারও আমি আওয়ামী লীগের কাছে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলাম। কিন্তু পাইনি। গতবারের পরাজিত নৌকার প্রার্থীকে এবারও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ভোটারদের চাপে এবারও আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আনারস প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি। নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে নৌকার প্রার্থীর নির্দেশে তাঁর কর্মীরা আমার ওপর হামলা করেছেন।’
অভিযোগের বিষয়ে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী হামিদুর রহমান বলেন, তাঁর কর্মীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রার্থী অহিদুল ইসলামের কর্মীদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। তবে এতে কেউ আহত হননি। নির্বাচনে কৌশল হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মিথ্যা অভিযোগ করছেন।
এদিকে, কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনী মহড়ায় যোগ দিতে আসা মোটরসাইকেলচালকদের মধ্যে প্রার্থী নিজে টাকা বিলিয়েছেন। ঘটনাটি সদর উপজেলার আবদালপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি)।
ওই ইউপিতে নৌকার চেয়ারম্যান প্রার্থী আরব আলী তাঁর নির্বাচনী মহড়ায় অংশ নেওয়া মোটরসাইকেলচালকদের হাতে ৫০০ টাকা করে গুঁজে দিয়েছেন। এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য প্রার্থী আরব আলী টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।