১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী সরাইল প্রেসক্লাব। আবারও দৃষ্টান্তমূলক কাজ করে ঐতিহ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন তারা। সেই সাথে নতুন আরেকটি ইতিহাস গড়েছে সরাইলের সাংবাদিকদের এ সংগঠনটি। মঙ্গলবার ১৪ ডিসেম্বর ছিল শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিবসটি পালন উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৯টায় সরাইল প্রেসক্লাবের সদস্যরা চলে যান সরাইল সদরের আলীনগর সৈয়দ বাড়ির কবরস্থানে। উদ্যেশ্য শহিদ বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আকবর হোসেন বকুল মিয়ার সমাধিতে পুষ্ফ অর্পণ করে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গকারী বীর শহিদের কবরটি পড়ে আছে নিশ্চিহ্ন অবস্থায়। প্রথমে অযতেœ অবহেলায় পড়ে থাকা কবরটি খুঁজে বের করতে সমস্যা হয়েছে। পরে ওঁর স্বজনদের সহায়তায় কবরটি কোন রকমে সনাক্ত করা হয়েছে। প্রেসক্লাবের সাংবাদিকরা কবরের উপরে গজিয়ে ওঠা ঘাস ময়লা আবর্জনা পরিস্কার করে নেন। সকলে মিলে গত ৫০ বছরের মধ্যে এই প্রথম আকবর হোসেনের সমাধিতে ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কিছুক্ষণ নীরবতা পালন শেষে কোরআন তেলাওয়াতের পর বকুল মিয়াসহ সকল শহিদদের রূহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। এ সময় বকুল মিয়ার বিধবা স্ত্রী নুরূল আক্তার ও পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। শহিদের স্ত্রী নুরূল আক্তার (৭৩) কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, পাঞ্জাবীরা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে আমার স্বামী আকবর হোসেন ও দেবর আফজাল হোসেনকে। লাশ এনে এখানে দাফন করা হল। ৫০টি বছর গেল। ফুল তো দুরের কথা। এই কবরের পাশে কেউ আসেনি। দেশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া এই মানুষটির কবরে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে কেউ আসেননি। রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বা সদস্য কাউকে সম্মান জানাতে দেখিনি। কবরটি সংস্কার বা সৌন্দর্য বর্ধনেও কারো কোন উদ্যোগ নেই। আমরা কিছুই চাইনি। চেয়েছিলাম শুধু সম্মান। তাও তো ভাগ্যে জুটেনি। ৫০ বছর পর আজ সরাইল প্রেসক্লাবের লোকজন কবরটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেছেন। ফুল দিয়ে সম্মান জানাচ্ছেন। কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করছেন। দু:খের মধ্যে খুশি ও আনন্দে বুকটা ভরে যাচ্ছে। সরাইল প্রেসক্লাবও বকুল মিয়ার মত আরেকটি ইতিহাসের জন্ম দিল। কারণ শহিদ বুদ্ধিজীবী বকুল মিয়ার সমাধিতে প্রেসক্লাবই প্রথম শ্রদ্ধা জানালো। এর আগে কেউ এ কাজটি করেননি। আমরা প্রেসক্লাবের এই উদ্যাগকে স্বাগত জানাই। তাদের জন্য দোয়া করি। প্রেসক্লাবের কাছে বকুল মিয়ার পরিবার ঋণী হয়ে গেল। তিনি আরো বলেন, স্বামী হারানোর পর তিন শিশু সন্তান নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। এখন পর্যন্ত সরকারি কোন ভাতা পায়নি। শেখ সাহেব একবার আমাকে ডেকে নিয়ে ২ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে ঢাকা বার সমিতির মূল ফটকের সামনে ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’ নামের স্মৃতিফলকে ৬ জন শহীদ আইনজীবির নামের সাথে বকুল মিয়ার নাম রয়েছে। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাউতলীর গোল চক্করে ‘সৌধ হিরন্ময়’ সৌধে ওঁর নাম আছে। ১৯৯৮ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবি সৈয়দ আকবর হোসেনের নামে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কর্তৃক “শহীদ বুদ্ধিজীবি স্মারক ডাক টিকেট” উম্মোচন করেছেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে শহীদ ১৯১ জন বুদ্ধিজীবীর গেজেট হয়েছে। সেখানে আকবর হোসেনর নাম স্থান পেয়েছে। কিন্তু ওঁর কবরটি রক্ষণাবেক্ষণ বা সৌন্দর্য বর্ধণে সরকারি কোন উদ্যোগ আজো জুটেনি। একজন শহিদ বুদ্ধিজীবীর সমাধি এভাবে অযতেœ অবহেলায় পড়ে থাকতে পারে না। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার বা কবরের উন্নয়নের জন্য কি সরকার কিছুই করছেন না? সরাইলের প্রশাসন বা জনপ্রতিনিধিরা তো গত ৫০ বছরের মধ্যে বকুল মিয়ার কবরের জন্য কিছু করতে দেখিনি। ফুলও দেয়নি। শহিদের স্বজন ও প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ কামরূজ্জামান বলেন, ঐতিহাসিক ও গুরূত্বপূর্ণ একটি কাজ করায় আমার সহযোদ্ধাদের কৃতজ্ঞতা জানায়। এই বীর শহিদের কবরের সৌন্দর্য বর্ধণের দাবী জানাচ্ছি। সরাইল মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ গণমাধ্যম কর্মী মোহাম্মদ বদর উদ্দিন ও সরাইল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মাহবুব খান বলেন, আমরা ভাষা শহিদদের প্রতীকী সম্মান জানাই। আর ৪ যুগেরও অধিক সময় পরও একজন শহিদ বুদ্ধিজীবীর সমাধিতে বছরে একবার কেউ শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে গত দেড় বছর পূর্ব থেকেই ভাবছিল সরাইল প্রেসক্লাব। প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর সরাইল প্রেসক্লাব এই শহিদ বুদ্ধিজীবীর সমাধিতে ফুল দিয়ে সম্মান জানাবে। এটাই করেছি আজ। এ কাজটির মাধ্যমে সমাজের দর্পণ ও রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ খ্যাত সাংবাদিকদের সংগঠন সরাইল প্রেসক্লাব কিছুটা হলেও ঋণমুক্ত হয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবী সরাইলের এ কৃতী সন্তান দেশ মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গকারী বকুল মিয়ার সমাধিকে সংস্কার করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হউক। বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য ও শহিদদের ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করা হউক। উপজেলা চত্বরে নির্মাণ করা হউক স্মৃতি স্তম্ভ। তবেই আগামী প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও শহিদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে জানতে পারবে। তাদের মধ্যে জাগ্রত হবে দেশ প্রেম।
প্রসঙ্গত: ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর সকাল বেলা। কোরআন তেলাওয়াত করছেন বকুল মিয়া। হাজির পাকবাহিনী। স্ত্রী স্বজনদের সামনে চোখ বেঁধে নিয়ে যান তাকে। পরের দিন ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনকে আটক করেন। দুজনই নিখোঁজ। ৪ দিন পর কুরূলিয়ার খাল পাড়ে মিলে দুই ভাইয়ের লাশ। বড়ই নির্মম! তাদের বুক পেট বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝড়া। অনেক অনুরোধের পর মন গলে বর্বরদের। ১০ ডিসেম্বর তাদের লাশ এনে দাফন করা হয়। আজ পর্যন্ত ওই বুদ্ধিজীবীর কবরে কারো শ্রদ্ধা নেই। নেই কোন সংস্কার।