দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৫ ই মে। দুপুরের দিকে মুক্তিবাহিনীর খোঁজে আখাউড়ার আজমপুর ক্যাম্পের দুটি পাকিস্থানী সেনা দল পৌরশহরের নারায়নপুর গ্রামে এসে হানা দেয়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় তারা গ্রামের চারদিকই ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধরতে গ্রামের ভিতর চিরুনি অভিযান চালায়। কিন্তু উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় পাক বাহিনী আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়-স্বজনসহ ১৮ জন বৃদ্ধ ও যুবককে ধরে জড়ো করে। তারা অন্যান্য গ্রামের আরো ১০ জনকে এখানে ধরে নিয়ে আসে। ওই দিন বিকালেই সবার হাত-পা বেঁধে আখাউড়া -আগরতলা সড়কের পাশে (তারাগণ ব্রিজ বরাবর) সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে। জীবন বাঁচাতে গুলিবদ্ধ অনেকেই খালের পানিতে ঝাঁপ দেয়। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বর্বর পাক বাহিনী পানিতেও গুলি করে এবং রাইফেলের বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে খঁচিয়ে তাদের হত্যা করে। শহীদ মুকশেদ আলীর ছেলে আখাউড়া পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা মনতাজ মিয়া স্মৃতিচারণ করে বলেন, গ্রামে পাক বাহিনী আসবে সংবাদ পেয়ে আমার আব্বা খুব সকালেই আম্মাসহ আমাদেরকে আগরতলায় পাঠিয়ে দেয়। দুপুরের দিকে তিনি নিজেও যাওয়ার জন্য ঘরে তালা দিয়ে ছোট ভাইকে ডাক দিতে গেলে পাক বাহিনী এসে আব্বাকে ধরে ফেলে। পরে আমার চাচা ওসমান আলী, বড় বোনজামাই বদর উদ্দিন, ভাগ্নে মাজনসহ গ্রামের ১৮ জনকে তারা ধরে। বিকালের দিকে আমাদের গ্রামের পাশে তারাগণ ব্রিজের সামনে সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে গ্রামের লোকজন নারায়ণপুর বাইপাস সড়কের পাশে একটি তেঁতুল গাছের নিচে আব্বাসহ সবাইকে কবর দেয়। আগরতলায় রমেশ দাসের বাড়িতে আমাদের আশ্রয় হয়েছিল। রাতে আব্বার মৃত্যু সংবাদটি আমরা পায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধিনতার এত বছর পেরিয়ে গেলেও শহীদ পরিবার হিসাবে আমাদের কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। গণকবরটি চিহ্নিত না করায় পবিত্রতা নষ্ট হচ্ছে। গণকবরটি সংরক্ষণ করে বেষ্টনী নির্মাণ করে দেয়ার পাশাপাশি আমাদেরকে যেন অন্তত শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি দেয়া হয়। পৌর যুবলীগের সভাপতি ও নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা মনির খান বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক স্বাধিনতার এতোবছর পরও গণকবরটি চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা হয়নি। কোনো ধরনের বেষ্টনী না থাকার কারণে গণকবরটি বেহালদশায় পড়ে রয়েছে। আমি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে দাবি জানাচ্ছি গণকবরটি যেন বেষ্টনি দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। আখাউড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার সৈয়দ জমশিদ শাহ বলেন, তারাগণ ব্রিজের কাছে নারায়ণপুর গ্রামের ১৮ জন ও অজ্ঞাতনামা আরো ১০ জনকে এখানে এনে পাক সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। গণকবর ও শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য কাগজপত্র মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুমানা আক্তার বলেন, গণকবরটি চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করার জন্য প্রযোজনীয় কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে অনেক আগেই পাঠানো হয়েছে।